বই সম্পর্কে : একটি বিরল গ্রন্থ জনাব নাজির ব্যুরোক্রেসির স্টিলফ্রেম ভেঙে শামিল হয়েছিলেন জনতার কাতারে। তাঁর প্রথম কর্মস্থান নাটোর—এইখানেই শুরু হলো তাঁর জীবন নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট। তিনি যখন নাটোরের দায়িত্ব নিলেন, ১৯৫৬ সালের শেষের দিকে—পাকিস্তানের বয়স তখন প্রায় দশ বছর। কিন্তু তখনো মহকুমায় সার্বিকভাবে মুসলমানেরাই গরিব এবং অনগ্রসর, তাদের কপালে কিছু জোটেনি পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে। গ্রামের এই অনগ্রসর মানুষগুলোকে প্রচ-ভাবে ধাক্কা দিলেন তিনি। নিগৃহীত বঞ্চিত, পিছিয়ে-পড়া মাটির মানুষগুলোকে যখন তিনি টেনে তুলতে চাইলেন, তখনই তিনি সাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত হলেন, কারণ ঐ পিছিয়ে-পড়া লোকগুলো বেশিরভাগই ছিল মুসলমান। জনাব নাজির কোনো পরোয়া না করেই তাঁর আন্দোলন চালিয়ে যান। নাটোরের মুসলমানরা এই প্রথম বুঝতে পারলো পাকিস্তানের অর্থ, স্বাধীনতার তাৎপর্য! নাটোর থেকে তিনি বদলি হলেন সিরাজগঞ্জ। এখানেই অসমসাহসী নাজির তাঁর চাকরির তোয়াক্কা না করে, আইন ভঙ্গের অপরাধে একজন প্রাদেশিক মন্ত্রীর সামনেই তাঁকে গ্রেফতারের আদেশ দেন। আইনের কাছে সকলেই সমান, এই বিশ্বাস ও নীতি যাঁর জীবনের মূলমন্ত্র, তাঁর তো ভয় পাবার কিছুই নেই। নাটোর ও সিরাজগঞ্জের পর তাঁকে বদলি করা হয় কুষ্টিয়া, কুষ্টিয়া থেকে ফরিদপুর। এরপর আরও কয়েকটি জেলায়—ভিন্ন রকমের দায়িত্ব নিয়ে। একজন ঈমানদার, সত্যনিষ্ঠ ও মানবদরদী কর্মকর্তা কীভাবে প্রশাসনের জটিলতা ও সমস্যাবলীর মুকাবিলা করেন, নিজের চাকুরির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে পরোয়া না করে। দীর্ঘ চাকরি জীবনের এসব ছোটো-বড়ো অসংখ্য অভিজ্ঞতার কথা নাজির বর্ণনা করেছেন তাঁর এই স্মৃতিকথায়। যা সত্য ও ন্যায়সঙ্গত, যা তাঁর মতে বিবেকের নির্দেশনা, সেইসব নির্দেশনা অনুসরণ করার জন্য জীবন নিয়ে তিনি যে বাজি খেলেন, নাজিরের স্মৃতির পাতায় বর্ণিত হয়েছে তারই প্রাণবন্ত কাহিনি উপন্যাসের মতো আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে। একজন আমলার গতানুগতিক স্মৃতিকথা নয়, একটা নতুন রাষ্ট্রের পশ্চাদ্পদ জনগণের জীবনে নবজন্মের উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য একজন আমলার উদ্দীপনাময় এ কাহিনি। বাংলা ভাষায় এ ধরনের সাহিত্য বিরল। তাঁর এ কাহিনি আমাদের নিকট-অতীতের ইতিহাসের উপর থেকে যবনিকা তুলে ধরে, আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে—আজকের নতুন কর্মকর্তারা এতে পাবেন প্রচুর অভয় এবং অনুপ্রেরণা।
লেখক পরিচিতি: পি এ নাজির ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্সসহ এম এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫২ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। পরবর্তিতে অধ্যাপনা ছেড়ে দিয়ে ১৯৫৪ সালে তিনি ‘সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান’-এ যোগ দেন। ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খান সারা পাকিস্তান থেকে যে ৩০৩ জন সরকারি কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করেন, তিনি ছিলেন তাঁদের একজন। ২০০৩ সালে তিনি পরলোকগমন করেন।