বাঙালি ইতিহাস গড়তে জানে, সে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে জানে না, এমনকি নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস থেকে যথাসময়ে উপযুক্ত শিক্ষাও গ্রহণ করে না—দীর্ঘদিন থেকে এমন একটি বদনাম চালু আছে বাঙালি জাতির নামে। বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায় তো প্রায় দুশ' বছর আগে এই ইতিহাসবিমুখতার জন্য গভীর আক্ষেপ করে বাঙালিকে অভাগা জাতি বলেছেন। পূর্বপুরুষদের কীর্তি ও গৌরবগাথা সম্পর্কে অবহিত নয়-এমন অভাগা জাতির মধ্যে বাঙালিকেই তিনি অগ্রগণ্য বলে চিহ্নিত করেছেন। অথচ হাজার বছরের পথপরিক্রমায় বাঙালির বীরত্বপূর্ণ এবং গৌরবময় অর্জন আছে অনেক। বুকের রক্ত ঢেলে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার যে ইতিহাস বাঙালি গড়েছে, গোটা পৃথিবীতে তার কোনো তুলনা নেই। পরাক্রমশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাসব্যাপী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাঙালি তার মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছে। দেশের জনগণের দেশপ্রেম, ঐক্য, মনোবল এবং সাহসিকতার কাছে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র এবং সমরকৌশল কীভাবে পরাজিত হয়, সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাঙালি জাতি মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে। এত বিরাট অর্জনের পেছনে আছে ত্রিশ লক্ষ শহিদের আত্মদান, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং এক কোটি দেশত্যাগী শরণার্থীর অমানবিক দুর্দশা ও কষ্ট ভোগের বেদনাসিক্ত ইতিহাস আছে, আছে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের উৎকণ্ঠিত দিনরাত্রি যাপনের দুঃখবহ ইতিহাস। বাঙালির অশেষ বীরত্ব আর বেদনার এ ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছে দিতে পারলে তারাও সম্পৃক্ত হতে পারবে পূর্বপুরুষের গৌরবের সঙ্গে, দুঃখদাহের সঙ্গে। তখন তাদের অন্তরেও জ্বলে উঠবে দেশপ্রেমের অগ্নিমশাল। পেছনের ইতিহাসের বর্তমান প্রজন্মের সম্পর্কের বাঁধনটা চিনিয়ে দিতে পারলে এই মশালের আলো সঞ্চারিত হবে প্রজন্মপরম্পরায়। সেই সঙ্গে প্রজন্ম হয়ে উঠবে শেকড়সংলগ্ন।
রফিকুর রশীদ। জন্ম ১৯৫৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, মেহেরপুর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৮৩ সালে সিলেটের এক চা-বাগানে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হিসেবে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। মন টেকে না সেখানে। যােগ দেন কলেজ। শিক্ষকতায়। দীর্ঘ ৩৩ বছর শিক্ষকতা শেষে মেহেরপুরের গাংনী কলেজ থেকে তিনি সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করেন। নিভৃতে কাব্যচর্চা দিয়ে শুরু হলেও সত্তর দশকের শেষভাগে পত্র-পত্রিকায় গল্প লিখেই তাঁর আত্মপ্রকাশ সাহিত্যজগতে। দেশের উল্লেখযােগ্য প্রায় সব কাগজে বিরামহীন লিখে চলেছেন গল্প আর গল্প, সঙ্গে উপন্যাসও। ছােট-বড় সকলের জন্যে। নির্মোহ চরিত্র চিত্রণ এবং বর্ণনার বিশ্বস্ততাই কথাশিল্পী হিসেবে তাকে এনে দিয়েছে বিশিষ্টতা। ছােটদের জন্য লেখা গল্প এবং উপন্যাসে রফিকুর রশীদ এনেছেন বিপুল বিষয় বৈচিত্র্য। প্রিয় প্রসঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ তাে আছেই, বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও কৌতূহলে ভরা বিচিত্র বর্ণে বর্ণিল ছােটদের নিজস্ব ভুবনের আলােকিত উপস্থাপন ঘটে চলেছে তার লেখা শিশু ও কিশাের সাহিত্যে। স্বপ্নজয়ের কথাশিল্পী রফিকুর রশীদ এরই মাঝে অর্জন করেছেন এম. নূরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, অধ্যাপক মােহাম্মদ খালেদ শিশু সাহিত্য পুরস্কার, চন্দ্রাবতী একাডেমি শিশু ও সাহিত্য সম্মাননা, কাজী কাদের নওয়াজ জন্মশতবর্ষ সম্মাননা, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, অরণি সাহিত্য পুরস্কার, কাঙাল হরিনাথ পদক ও পুরস্কার, বগুড়া লেখকচক্র স্বীকৃতি ও সম্মাননা, সাতক্ষীরা সাহিত্য একাডেমি সম্মাননা, সিকান্দার আবু জাফর সাহিত্য পুরস্কার, দ্বিজেন্দ্র পুরস্কার (ভরত) প্রভৃতি।