পৃথিবীর ইতিহাসে একাধারে একাধিক শ্রেষ্ঠ 'শাসক' সাধারণত পাওয়া যায় না। একজন শ্রেষ্ঠ শাসকের পর আরও কয়েকজন চলে যাবার পর আবারও হয়তো আসেন আরেকজন শ্রেষ্ঠ শাসক। নবিজির (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতিকালের পর মুসলিমরা এক নতুন শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করেন৷ এটি 'খিলাফত' নামে পরিচিত। যাঁরা খিলাফত পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদের 'খলিফা' নামে ডাকা হতো। ইসলামের প্রথম চার খলিফা পৃথিবীর ইতিহাসে যেকোনো সময়ের, যেকোনো শাসকের চেয়ে ন্যায়নিষ্ঠ ছিলেন। ধারাবাহিক চারজন শ্রেষ্ঠ খলিফা, শাসক, রাষ্ট্রপ্রধানের এমন ইতিহাস বিরল। চারজন খলিফা প্রত্যেকেই দুনিয়ার বুকে জান্নাতের সুসংবাদ পান। তাঁরা যেমন ছিলেন দুনিয়ার বুকে শ্রেষ্ঠ, তেমনি আসমানবাসীর কাছেও তাঁরা শ্রেষ্ঠ। এমন 'শাসক' পৃথিবীর ইতিহাসে আর পাওয়া যাবে? এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে যে কজন ইতিহাবিদের লেখা সর্বাধিক পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে, ড. শায়খ আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি তাদের অন্যতম। তাঁর কলমের আঁচড়ে চিত্রিত হয় ইতিহাসের ব্যাপৃত বয়ান। ফলে প্রতিটি গ্রন্থই হয়ে ওঠে বিষয়সংশ্লিষ্ট একেকটি হীরকখণ্ড যেন। বিশেষ করে তাঁর রচিত চার খলিফা সিরিজ। আরবির পাশাপাশি তুর্কি, ইংরেজি, উর্দু, বাংলাসহ বহু ভাষায় অনূদিত হচ্ছে গ্রন্থগুলো। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে থাকা শিক্ষাকে তুলের ধরার ক্ষেত্রে সাল্লাবি যেমন দূরদর্শী, তেমনি বিশ্বস্তজন হিসেবে আদৃত পাঠক ও বোদ্ধা মহলে।
ফকিহ, রাজনীতিক ও বিশ্বখ্যাত ইতিহাসগবেষক। ইসলামের ইতিহাসের উপর বিশ্লেষণধর্মী তাত্ত্বিক গ্রন্থ রচনা করে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। এই মহা মনীষী ১৯৬৩ সনে লিবিয়ার বেনগাজি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা বেনগাজিতেই করেন। যৌবনের প্রারম্ভেই গাদ্দাফির প্রহসনের শিকার হয়ে শায়খ সাল্লাবি আট বছর বন্দি থাকেন। মুক্তি পাওয়ার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি সাউদি আরব চলে যান। মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়া ও উসুলুদ্দিন বিভাগ থেকে ১৯৯৩ সনে অনার্স সম্পন্ন করেন। তারপর চলে যান সুদানের উম্মু দুরমান বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে উসুলুদ্দিন অনুষদের তাফসির ও উলুমুল কুরআন বিভাগ থেকে ১৯৯৬ সনে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৯৯ সনে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘ফিকহুত তামকিন ফিল কুরআনিল কারিম’। ড. আলি সাল্লাবির রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু বিশ্বখ্যাত ফকিহ ও রাজনীতিক ড. ইউসুফ আল কারজাবি। কারজাবির সান্নিধ্য অর্জনে তিনি ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে কাতার গমন করেন। নতুন ধারায় সিরাত ও ইসলামি ইতিহাসের তাত্ত্বিক গ্রন্থ রচনা করে ড. আলি সাল্লাবি অনুসন্ধিৎসু পাঠকের আস্থা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। নবিজির পুর্ণাঙ্গ সিরাত, খুলাফায়ে রাশিদিনের জীবনী, উমাইয়া খিলাফত, আব্বাসি খিলাফত, উসমানি খিলাফতের উত্থান-পতনসহ ইসলামি ইতিহাসের সাড়ে তেরোশ বছরের ইতিহাস তিনি রচনা করেছেন। তা ছাড়া ইসলামি ইতিহাসে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করা ব্যক্তিদের নিয়ে তিনি আলাদা আলাদা গ্রন্থ রচনা করেছেন। ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবির রচনা শুধু ইতিহাসের গতানুগতিক ধারাবর্ণনা নয়; তাঁর রচনায় রয়েছে বিশুদ্ধতার প্রামাণিক গ্রহণযোগ্যতা, জটিল-কঠিন বিষয়ের সাবলীল উপস্থাপনা ও ইতিহাসের আঁকবাঁকের সঙ্গে সমকালীন অবস্থার তুলনীয় শিক্ষা। এই মহা মনীষী সিরাত, ইতিহাস, ফিকহ ও উলুমুল কুরআনের উপর আশির অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচনাবলি ইংরেজি, তুর্কি, ফরাসি, উর্দু ও বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়ে পৃথিবীর জ্ঞানগবেষকদের হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। আল্লাহ তাঁকে দীর্ঘ, নিরাপদ ও সুস্থ জীবন দান করুন। আমিন। —সালমান মোহাম্মদ লেখক, অনুবাদক ও সম্পাদক ২৪ মার্চ ২০২০