ভূমিকা :- মানুষের মতো শেয়ালরাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পৃথিবীর সর্বত্র। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে পৃথিবীর সব মানুষের মনে শেয়াল সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা এক। শেয়ালকে সবাই চতুর, ধূর্ত, বুদ্ধিমান এবং শঠ বলে জানে। সমাজের চতুর ও বুদ্ধিমান মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে সে। শেয়াল সম্পর্কে সব মানুষের একই ভাবনা হলো কেমন করে? আমরা জানি, একই পরিবার থেকে মানবজাতির উদ্ভব। জীবিকার তাগিদে তথা প্রাকৃতিক কারণে সেই ক্ষুদ্র মানবগোষ্ঠী ক্রমশঃ ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর আনাচে কানাচে। পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও তারা সঙ্গে করে নিয়ে গেছে তাদের পূর্বপুরুষের চিন্তাচেতনাকে-লোককাহিনীর বিশাল ঐশ্বর্যকে। আজ বিশ্ব জুড়ে চলছে ব্যাপক মারামারি, হানাহানি। এক দেশের মানুষ আরেক দেশের মানুষকে, এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের মানুষকে, এক বর্ণের মানুষ আরেক বর্ণের মানুষকে শত্রু ভেবে পরস্পরের প্রাণ সংহারে লিপ্ত রয়েছে। তাদের জানাতে হবে, মানুষ একে অপরের শত্রু নয়। তারা একই পরিবারের সদস্য। আদিতে তারা একটা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমায় একসঙ্গে বাস করতো। শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য তারা ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করতো। প্রকৃতি ছিল তাদের তখন প্রধান শত্রু। সেই শত্রুকে বিজ্ঞানের জোরে আজ মানুষ পরাভূত করেছে। পৃথিবীতে তখনো মানুষের মাথার উপরে যেমন ছিল বিশাল বিস্তারিত আকাশ, সে আকাশ, সে গাছপালা, পশু-পাখি আজো আছে। এদের নিয়ে মানুষের চিন্তা-ভাবনা আজো আছে। পূর্বপুরুষদের সেই পুরাতন গল্প আজো তারা বিস্মৃত হয়নি। এই গল্পগুলোর ভেতর দিয়ে বৃহত্তর মানবগোষ্ঠী তাদের সেই পরিচয়ের গভীর সূত্রকে আজো জিইয়ে রেখেছে অম্লানভাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শেয়ালদের নিয়ে প্রচলিত গল্পগুলোকে একত্রিত করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভৌগোলিক দূরত্ব সত্ত্বেও মানবজাতি যে একই গোষ্ঠী থেকে উদ্ভূত এবং তারা যে একই পূর্বপুরুষের বংশধর, তা আজকের শিশুদের জানিয়ে দেয়া। হিংসার বিষবাষ্প থেকে তাদের মুক্ত করে আদিম সমাজের মতোই তারা পরস্পরকে আপন বলে জানবে। পিছিয়ে পড়া ভাইকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে যাওয়া ভাই এগিয়ে আসবে। এটি একটা গবেষণা সংকলন বা নিছক শিশুগ্রন্থ নয়। গল্পগুলো একদিকে গবেষকদেরও যাতে কাজে লাগে অপর দিকে শিশুরাও যাতে উপভোগ করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা হয়েছে। অলংকার বর্জন করে সহজ এবং সরল ভাষায় লেখার চেষ্টা করেছি। আদিম সরলতার সুর যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় সে বিষয়ে সচেতন থেকেছি। কোথাও কোথাও তার ব্যতিক্রমও ঘটতে পারে-সেটা আমার অক্ষমতার জন্যেই । পৃথিবীর সব দেশের শেয়ালের গল্প সংগ্রহ করা আমার পক্ষে এখনো সম্ভব হয়নি। ঈশপের গল্পসহ মাত্র ৩০টি দেশের গল্প এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো পাওয়া গেলে তা ভিন্ন ভিন্ন খন্ডে অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছা আছে। মুক্তধারা আমাকে ইতোমধ্যে সে আশ্বাস দিয়েছে। :- শাহজাহান কিবরিয়া
"শাহজাহান কিবরিয়ার পোশাকি নাম মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া। জন্ম ২৪ জানুয়ারি ১৯৪১। নোয়াখালী জেলার অধুনালুপ্ত শহর এবং মাইজদী কোর্ট শহরে কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। ১৯৫৭ সালে নোয়াখালী জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৬০ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে আই এ পাস করেন। বি এ প্রথম বর্ষ ঢাকা কলেজ ও পরে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ১৯৬৩ সালে বি এ (সম্মান)। ১৯৬৪ সালে বাংলায় এম এ পাস করেন। ১৯৬৩ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু। পরে দৈনিক গয়গাম, ফ্র্যাঙ্কলীন বুক প্রেত্মামস, পাকিস্তান কাউন্সিলর, দৈনিক গণবাংলা, দৈনিক পূর্বদেশ, বাংলা একাডেমি এবং সবশেষে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন। শাহজাহান কিবরিয়া মৃদুভাষী, সজ্জন, অন্তর্মুখী মানুষ, তবে অন্তরে তাঁর রয়েছে দৃঢ়চিত্ততা এবং এর উৎস যেমন তাঁর ব্যক্তিসত্তা, তেমনই স্বদেশাত্মার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা। নিভৃতচারী সাধকের মানস তিনি ধারণ করেন ভেতরে, বাইরের আড়ম্বর সযত্নে পরিহার করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অনেকটা সময় ছিল তমসাচ্ছন্ন, সেই বৈরি পরিবেশেও তিনি যথাসাধ্য সচেষ্ট ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতিকে স্নাত করা, বিশেষভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের বাণী পৌঁছে দিতে। এই কাজে তাঁর অবলম্বন হয়েছে শিশু- কিশোরদের জন্য লেখালিখি এবং সৃজনশীল সাহিত্য রচনা। শাহজাহান কিবরিয়া সাহিত্যে মূল্যবান অবদান রাখার জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও শিশু একাডেমি পুরস্কারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক পুরস্কার পান। প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৫০টির অধিক। সহজ সরল সাহিত্য উপাদান ও শাণিত নির্মাণশৈলী তাঁর রচনার প্রাণ। তিনি একদিকে নিজস্ব মৌলিক রচনার মধ্য দিয়ে পাঠক হৃদয় জয় করেছেন, অন্যদিকে বিদেশি রূপকথা ও লোককাহিনি অনুবাদ করে আমাদের শিশু সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত করেছেন। তাঁর রচনায় রয়েছে আলাদা মাধুর্য ও শক্তি।"