শুক্রবার দিন সকাল ন'টা পর্যন্ত ঘুমানোই হলো চিশতির নিয়মিত বদ- অভ্যেসগুলোর একটি। অন্যান্য দিন অবশ্য কোনো কাজ থাকুক না থাকুক, চিশতি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে যায়। উঠে পড়ে আজানের সাথে সাথেই। সে নিয়মিত নামাজি হলেও শুক্রবার দিনটা ব্যতিক্রম ঘটে। বৃহস্পতিবার সারা রাত জেগে বিশ্বের যত রোমাঞ্চকর উপন্যাস, থ্রিলার, ভৌগোলিক বিষয়, অ্যাডভেঞ্চারের বই ও পত্রিকা যেমন পড়ে, তেমনি দুনিয়ার কোথায় কোন রহস্যময় বিষয়কে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে ফিল্ম, শর্টফিল্ম বা ভিডিও রেকর্ড, সেসবের কালেকশন থেকে, কালেকশন না বলে চিশতির নিজস্ব ভিডিও লাইব্রেরিই বলা ভালো। এসব নিয়েই তার বৃহস্পতিবার রাতটা সাবাড় হয়ে যায়। শুক্রবার ঘুম থেকে জাগতে এ জন্যই দেরি। দেরি করে উঠলেও নামাজটা দ্রুত সেরে নিয়ে নাস্তার টেবিলে আসে। তারপর ধীরেসুস্থে নাস্তাটা সেরে একটা গোল্ড লিফ সিগ্রেট ধরিয়ে তার দিকে স্নেহদৃষ্টিতে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকা এক সৌম্য সাদা থানপরা বৃদ্ধাকে বলবে, 'যাক, সকালের পাট চুকে গেল ফুপু। এখন ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে ভূগোল বিভাগে একটু তবলা বাজিয়ে আসি। তুমি দুপুরের খাবার নিয়ে আমার জন্য বসে থাকলে আমি আগামীকাল থেকে বাৎসরিক রোজা রাখার প্রতিজ্ঞা করব। তুমি এই অধম ভাইপোর অপেক্ষা না করে খেয়ে নেবে। এর অন্যথা করলে বুঝতেই তো পারছ আমার প্রতিজ্ঞা?' নাস্তা পরিবেশনকারিণী চিশতির দিকে স্নেহদৃষ্টি তুলে বললেন, 'তোর আজকাল বাইরে লাঞ্চ না খেলে পেট ভরে না সেটা কি আর জানি না? বাসায় এসে তোকে খেতে বলি তো আমার নিজের জন্য। একা একা দুপুরের খাওয়া খেতে আমার যে কী খারাপ লাগে হতভাগা, সেটা যদি বুঝতি, তাহলে সব ফেলে দুপুরে বাড়ি এসেই খানা খেতি।'
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন আল মাহমুদের কবিতার বই পড়েননি এমন সাহিত্যপ্রেমী খুঁজে পাওয়া ভার। গুণী এই কবি একাধারে একজন সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে তার কবি পরিচয়। আধুনিক বাংলা কবিতা নানা দিক থেকে তার কাছে ঋণী থাকবে। বাচনভঙ্গি আর রচনাশৈলীতে তার কবিতা সমকালীন যেকোনো কবির তুলনায় অনন্য। ‘কবিতাসমগ্র’ (দুই খন্ড) ‘উড়ালকাব্য’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘আল মাহমুদের স্বাধীনতার কবিতা’, ‘প্রেমের কবিতা সমগ্র’, ‘আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ইত্যাদি কবিতার বই নিয়ে আল মাহমুদ কবিতাসমগ্র। এছাড়াও আল মাহমুদ উপন্যাস সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে তিন খণ্ডে। জাতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক টানাপোড়েন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি ও প্রেক্ষাপটসহ সমাজ ও ব্যক্তি জীবনের দ্বন্দ্ব স্থান পেয়েছে আল মাহমুদ এর বই সমূহ-তে। ‘কালের কলম’, ‘লোক লোকান্তর’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘গল্প সমগ্র’, ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য লেখা। আল মাহমুদের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে। তার পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। শিক্ষাজীবনেই তিনি লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত হন। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল আর মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী পাঠ করতে করতে নিজের কবি প্রতিভা আবিষ্কার করেন তিনি। ১৯৫৪ সালে সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। কিছুকাল পরই এ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। পুরো ৬০-এর দশক জুড়ে তিনি অসংখ্য কবিতা রচনা করেন এবং কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রবাসী সরকারের হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ পত্রিকায় সরকার বিরোধী লেখালেখির কারণে এক বছরের জন্য কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয় তাকে। ১৯৭৫-৯৩ সাল পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে কাজ করে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কবি আল মাহমুদ তার অনবদ্য রচনাশৈলীর জন্য ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’, ‘একুশে পদক’, ‘জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার’, ‘নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক’ সহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ২০১৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তিনি পরলোকগমন করেন।