বিংশ শতাব্দী কেবল বিশ্ব ক্ষেত্রে নয় বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তি ও মনন চর্চার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুই শতাব্দীতে বিস্তৃত রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বাঙালির সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্রে বিশ্বমানের বহু মনীষীর আবির্ভাব ঘটেছে। সামাজিক বিবর্তন ও অভিজ্ঞতার অগ্রগতির মধ্য দিয়ে চিন্তা চেতনা সম্পূর্ণতা অর্জনের পর্যায়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৪৭ সালের দেশভাগ মনুষ্যত্বের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন। বাংলাভাষি ভূ-খ-ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় আঘাত হিসেবে দেখা হয় ১৯৪৭ এর দেশভাগ। কারণ এখানে বাঙালিত্বের পরিবর্তে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত সংকীর্ণ চিন্তাকে রাজনৈতিক আদর্শে রূপ দেয়া হয়। এ পরিস্থিতিতে বাঙালির মননচর্চা দুই ধারায় বিভাজিত হয়ে যায়। প্রথম ধারা প্রথাগত ও প্রতিষ্ঠিত ধারা পশ্চিম বঙ্গকেন্দ্রিক। দ্বিতীয় ধারা পাকিস্তান অন্তর্গত বর্তমান বাংলাদেশ ভূখ- কেন্দ্রিক। প্রান্তিকজনের জ্ঞানতাপস অধ্যাপক যতীন সরকারের চিন্তা চেতনার বৈচিত্র্য অনুধাবন করতে গিয়ে আমি বাঙালির মননচর্চার পূর্ববর্তী স্বভাবধর্ম উল্লেখ করলাম। কারণ যতীন সরকার কেবল প্রান্তিক মানুষ নন, প্রান্তিক জীবনের বুদ্ধিজীবী নন, তিনি বাঙালির মননশীলতার প্রগতিশীল ধারার অন্যতম রূপকার। বিধান মিত্র তার জ্যোতির্ময় যতীন সরকার গ্রন্থে এই অসাধারণ বাঙালি মনীষীর জীবন ও চিন্তাচর্চার বৈচিত্র্যকে বিশ্লেষণ করেছেন। বিশ্লেষণ সহজ কাজ কিন্তু বৈচিত্র্যের বিশ্লেষণ অনেকক্ষেত্রেই ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি করে। বিধান মিত্রের পূর্ববর্তী রচনাগুলো থেকে আমার যে ধারণা তিনি এখানেও সে ভারসাম্যপূর্ণ ও অন্তর্ভেদী বিশ্লেষণকে গুরুত্ব দিয়েছেন। যতীন সরকারের সৃষ্টির জগত বিচিত্র ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। বিধান মিত্র তার জ্যোতির্ময় যতীন সরকার গ্রন্থের বিষয় বিভাজন ও বিন্যাস এই বৈচিত্র্যকে অত্যন্ত শৃঙ্খলার সঙ্গে বিন্যস্ত করেছেন। ভাষা ও সাহিত্য, ইতিহাস ও দর্শন, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি, লোকসাহিত্য ও লোকঐতিহ্য, বাংলাদেশের ক্ষণজন্মা লোকসাহিত্য গবেষক ও সংগ্রাহক, কবিগান, ধর্ম ও ধর্মতন্ত্র, বাংলা কবিতার মূলধারা ব্যাখ্যার অভিনবত্ব থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল ইসলামের কৃতি ও কীর্তির ব্যাখ্যায় তাঁর যে নিজস্বতা ও স্বাতন্ত্র্যকে লেখক দক্ষতার সঙ্গে সনাক্ত ও বিশ্লেষণ করেছেন। এছাড়া আত্মজৈবনিক গ্রন্থগুলোতে যতীন সরকারের রাজনৈতিক দর্শন দেশভাগ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। যতীন সরকার মূলত দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী এবং প্রাকৃতজনের দার্শনিক। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে-কোনো দর্শন বাঙালি জীবন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্ররূপ নেয়। আমার পঠিত লেখকদের মধ্যে যতীন সরকারের মধ্যেই আমি একমাত্র সেই স্বতন্ত্র চরিত্রের প্রাকৃত জীবনের দ্বান্দ্বিকতার স্বরূপ খুঁজে পেয়েছি। অধ্যাপক বিধান মিত্র অত্যন্ত গভীর মনোনিবেশ ও পর্যবেক্ষণের সঙ্গে যতীন সরকারের বিচিত্র অবলোকনকে যেভাবে গ্রন্থভুক্ত করেছেন সাহিত্যের একজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হিসেবে কেবল নয়, একজন কৈশোর থেকে মার্কসীয় তত্ত্বের অনুসারী হিসেবে আমার কাছে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। যতীন সরকার জীবন, জীবিকা ও মননচর্চায় প্রান্তিক জীবনবাসী। কিন্ত দার্শনিক বীক্ষা অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে চিরকালের আন্তর্জাতিক। মার্কসীয় জীবনবীক্ষাকে তিনি বাঙালির জীবনচর্চা, মননশীলতা ও সাহিত্যভাবনার ক্ষেত্রে নিজস্ব বৈজ্ঞানিক চিন্তাশৃঙ্খলার ন্যায়ে তাঁর সমগ্র রচনায় তুলে ধরেছেন। একজন অকপট সত্য সন্ধানী মানুষের যে স্বরূপ তাঁর রচনাগুলোতে অভিব্যক্ত হয়েছে বিধান মিত্র তার গ্রন্থে সেগুলোকেই নিজস্ব চিন্তা ও বিষয় শৃঙ্খলায় উপস্থাপন করেছেন।
বিধান মিত্র : জন্ম নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলায়, গােপালপুর গ্রামে (০১ এপ্রিল, ১৯৬৮); সরকারি কলেজের সহযােগী অধ্যাপক। উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ : উপন্যাস : বনে যদি ফুটল কুসুম, মুক্তিযুদ্ধ রাজদর্শন, শরণার্থী-'৭১ গল্পগ্রন্থ : মানুষ ও লাশ, টক-ঝালমিষ্টি প্রবন্ধগ্রন্থ : শিক্ষা-অশিক্ষা-কুশিক্ষা, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা : রূপ ও রীতি ছড়াগ্রন্থ : শেয়াল-সিংহের রাজত্বে।