বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি ‘পথের পাঁচালী’। চিরায়ত বাংলার সমস্ত রূপ রসই এই উপন্যাসের মনোমুগ্ধতার আধার। উপন্যাসটি পড়ার সময় লেখকের বর্ণনাশৈলীর গুণে পাঠক সেই মনোমুগ্ধতাকে খুঁজে পাবেন। শিল্পীর তুলিতে বিভূতিভূষণ এঁকেছেন দূর অতীতের সাথে পল্লিবাংলার জীবনের গ্রামীণ যোগ। এই চিরায়ত বাংলার আশা-আকাঙ্ক্ষা, নৈরাশ্য-বেদনার ছবিসহ দারিদ্র্যলাঞ্ছিত পল্লিগ্রামের বালক-বালিকার মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণ করেছেন লেখক । করুণ রস নিষিক্ত করে কাহিনির পরতে পরতে সংযোজন করেছেন মানবজাতির আদি এক অনুভূতি– মায়া। প্রগাঢ় ভালোবাসা ফুটিয়ে তুলেছেন উপন্যাসের চরিত্রগুলোতে, অতি সাধারণ ঘটনাপ্রবাহেই পাঠকের মনে তা সঞ্চার করে গভীর মমত্ববোধ। ইছামতীর তীরে নিশ্চিন্দিপুর গাঁ-এর ব্রাহ্মণ রায় পরিবারের দারিদ্র্যের সংগ্রাম, গ্রামীণ সংস্কারের আড়ম্বরতা, ব্রিটিশদের অধীনে গ্রাম্য সমাজের দশা, বিপরীতভাবেই অবস্থাপন্ন বাড়িগুলোতে চোখ-ধাঁধানো জাঁকজমক– সবকিছু ছাপিয়ে ক্রূর হাসি হেসেছে অমোঘ অদৃষ্ট। এরই মাঝে সপ্রতিভ এক বালকের জন্ম হতে ধীরে ধীরে বেড়ে-ওঠা আর নিষ্ঠুর বাস্তবতার পাঠশালায় হাতেখড়ি নেয়া। বোন দূর্গার হাত ধরে যে প্রকৃতিকে চিনতে শিখেছিল ছোট্ট অপু, সেই প্রকৃতির মাঝেই যেন জড়িয়ে গিয়েছে তার অস্তিত্ব। যে স্পৃহার সৃষ্টি অপুর মনে, বনদেবতার অভয়বাণী ‘সামনে এগিয়ে যাওয়াই জীবন’ থেকে। উপন্যাস-শেষে তাই গভীর জীবনবোধ, আর বিষণ্ন মমতায় ভেজা চোখে পাঠক সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন অপু’র প্রতি।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।