নিতাই-এর ছিল কবিগান শোনার নেশা। ওই গান শুনেই তার সত্তার উর্বর জমিনে কবিত্ব-প্রতিভার জন্ম হয়। স্বতঃস্ফূর্ত, অলৌকিক প্রতিভাপ্রাপ্ত কবিত্ব-শক্তির নেশায় সে হল ব্যতিক্রমধর্মী। কথায় কথায় হৃদয় থেকে উৎসারিত কবিতার চরণ তার মুখ থেকে বের হয়ে পড়ে। অসাধারণ তার ব্যঞ্জনা, লালিত্য সুর, ছন্দ। উপন্যাসটিতে ব্যক্তির উত্থান-পতন, জয়-পরাজয় আর প্রত্যাশা-প্রাপ্তির আড়ালে লেখক বিচিত্র অবসরে পাঠককে জানিয়েছেন মানবজীবনবিষয়ক অনেক অনেক বারতা। সমাজ-সংসারে আমাদের প্রতিদিনের আচার-আচরণের মধ্যে যে-সব নিরীক্ষা এবং দর্শন প্রকাশ পায়, সেসবের খণ্ডচিত্র রূপ লাভ করেছে এই উপন্যাসে। সংসারে ভালোবাসার যে কোনো বিকল্প নেই, সে কথা ঔপন্যাসিক বহুভাবে পরিবেশন করতে চেয়েছেন। নিতাই ঠাকুরঝিকে পায়নি; বসন্তকে পেয়েও হারিয়েছে চিরতরে। ঠাকুরঝি নিতাইকে ভালোবেসে হারিয়েছে সংসার, ইহকাল; যন্ত্রণা আর বিরহে মরতে হয়েছে তাকে। বসন্ত অবাধ যৌনজীবনের ফলস্বরূপ লাভ করেছে অপ্রতিরোধ্য রোগ আর শেষত মৃত্যু। জীবন যে সত্যি খুব ছোট; একজীবনে আমাদের সব আশা যে পূরণ হওয়া সম্ভব নয়- এ সত্য প্রকাশ হয়েছে নিতাইয়ের একটি গানে। নিতাই জানে বসন্তকে ভালোবেসেও তার সুখ হবে না। ঠাকুরঝিকে ভালোবেসে জীবনের লীলাটা অসমাপ্ত রেখে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে এসে পড়েছে বসন্তের মোহে। নিতাই জীবনের পোড়-খাওয়া মানুষ; ভালোবাসতে গিয়ে, নিজেকে পরিচিত নোংরা পরিবেশ থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে গিয়ে বারবার তাকে হোঁচট খেতে হয়েছে। ঠাকুরঝিকে ভালোবেসে পেয়েছে কষ্ট, বসন্তকে ভালোবেসেও পায়নি সুখ।
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় বিংশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ছিলেন। ১৮৯৮ সালের ২৪ জুলাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় তাঁর জন্ম। তাঁর শৈশব কাটে এই বীরভূম জেলারই লাভপুর গ্রামে। ধর্মপরায়ণ ও আদর্শনিষ্ঠ বাবা-মায়ের কাছে তিনিও একই সততা ও আদর্শের শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন। লাভপুরের যাদবলাল হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। তবে নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম শেষ করতে পারেননি। ভারতীয় স্বাধীনতা বিপ্লবের সময় রাজনৈতিক কারণে কারাভোগ করতে হয় তাঁর। মুক্তি পাওয়ার পর সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন পুরোপুরি। তাঁর অনন্য প্রতিভায় জন্ম নিয়েছে একেকটি অসাধারণ পাঠকনন্দিত সাহিত্যকর্ম। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় রচনাবলী বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সমৃদ্ধ সম্পদ। তাঁর লেখা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের জীবনকে এককভাবে উপস্থাপন করে না, ফুটিয়ে তোলে গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের সব বৈশিষ্ট্যকে। সাহিত্য সৃষ্টি করতে তিনি বাদ রাখেননি কোনো শাখা। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হলো ‘চৈতালি ঘূর্ণি (১৯৩২)’, ‘পাষাণপুরী (১৯৩৩)’, ’ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯)’, ’কালিন্দী (১৯৪০)’, ’কবি (১৯৪৪)’, ’হাসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৫১)’, ‘কালরাত্রি (১৯৭০)’ ইত্যাদি। তারাশঙ্করের উপন্যাস সমগ্র সংখ্যার হিসাবে প্রায় ৬৫টি। এর মধ্যে ‘কবি’ উপন্যাসটি তারাশঙ্করের কালজয়ী উপন্যাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামার মাঝে তিনি বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী ও সাহিত্য সম্মেলন এর নেতৃত্ব দান ও সভাপতিত্ব করেন। পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবে তিনি আট বছর দায়িত্ব পালন করেন। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় কবিতা সমগ্র হল ‘ত্রিপত্র (১৯২৬)। এছাড়াও সাহিত্য রচনা করেছেন ছোটগল্প, নাটক, প্রহসন ও প্রবন্ধ আকারেও। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ছোটগল্প সংকলন হলো ‘ছলনাময়ী (১৯৩৭)’, ‘রসকলি (১৯৩৯)’, ‘হারানো সুর (১৯৪৫)’, ‘কালান্তর (১৯৫৬), ‘মিছিল (১৯৬৯)’, ‘উনিশশো একাত্তর (১৯৭১)’ ইত্যাদি। তাঁর রচিত অনেক উপন্যাস পেয়েছে চলচ্চিত্র রূপ, এদের মাঝে আছে ‘কালিন্দী’, ‘দুই পুরুষ’, ‘জলসাঘর’, ‘অভিযান’। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় উপন্যাস সমগ্র বাঙালি পাঠকের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘শরতস্মৃতি পুরস্কার (১৯৪৭)’, ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক (১৯৫৬)’, ‘রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৫৫)’, ‘পদ্মশ্রী (১৯৬২)’, ‘পদ্মভূষণ (১৯৬৮)’ ইত্যাদি পুরস্কার ও উপাধি লাভ করেন। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় এর বই সমূহ মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী স্থান করে নিয়েছে। পাঠকনন্দিত এই বাঙালি কথাসাহিত্যিক ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পরলোকগমন করেন।