মনীষী-লেখক আমরা তাঁদেরকেই বলি যাঁদের রচনায় একই সঙ্গে যুগ ও যুগান্তরের স্বপ্ন-সাধনা মূর্ত হয়ে ওঠে। প্রয়াত আহমদ ছফা বাংলাদেশের সেরকম মানসিকতাসম্পন্ন একজন লেখক। রচনাশৈলীর সঙ্গে মনীষার এমন সম্মিলন কখনো কখনো ঘটে, তবে সব লেখকের বেলায় ঘটে না। সাহিত্যিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে আমাদের কালের এক চিন্তানায়কের মর্যাদায় তাঁকে অধিষ্ঠিত করেছে তাঁর প্রজ্ঞা, মননশীলতা, অন্তর্দষ্টি, ইতিহাসবোধ, ঐতিহ্য-সচেতনতা, মানবপ্রীতি, সামাজিক দায়বদ্ধতা। তাঁর জীবদ্দশায় যাঁরা হয়তো অনেক বিষয়ে তাঁর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতেন এমনকি তাঁদের পক্ষেও তাঁর চিন্তার প্রাতিস্বিকতা ও প্রতিভার মৌলিকত্বকে অস্বীকার করার উপায় ছিল না এমন এখনো নেই। প্রবন্ধ সমগ্র গ্রন্থটি আহমদ ছফার পাঠকনন্দিত কিছু প্রবন্ধ নিয়ে গ্রথিত। এগুলো যেমন আলোচিত তেমনই সমালোচিত। বলতে গেলে এটাই প্রবন্ধের স্বার্থকতা। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্রাচার, সমালোচনা, জীবন, মূল্যবোধ, ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, নান্দনিকতা, শিক্ষা ব্যবস্থা, গ্রাম, নগর, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ মানুষ, চোরাচালান, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ভাষা এবং পররাষ্ট্রসহ প্রাত্যাহিক জীবনের আরও অনেক বিষয় প্রকৃষ্ট কৌশলে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় মনকাড়া যুক্তিতে বিধৃত। প্রবন্ধকে যদি শরীরের সাথে তুলনা করা হয় তাহলে আত্মজ্ঞান-নিবিড় প্রকৃষ্ট অনুসন্ধানের পক্ষপাতহীন যোজনা আহমদ ছফার প্রবন্ধের অবয়ব, নির্লোভ আভিজাত্যের সাহসী উচ্চারণ মাংশপেশী, দূরদর্শী চেতনার শালীন বাক্যবান তার শক্তি, জাগরনময় অনুভবের প্রীতম প্রতীতি হৃদপিণ্ড, বাস্তবতার নিরিখে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মুক্তবুদ্ধিঘন সমন্বয় মস্তিষ্ক এবং আকর্ষণীয় বাক্যের মন্দ্রিত প্রাঞ্জলতা তাঁর প্রবন্ধের সৌন্দর্য।
বাঙালি মুসলিম লেখকদের মধ্যে অন্যতম কীর্তিমান কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, গণবুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান আহমদ ছফা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামে। নিজ এলাকায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়, এবং ১৯৫৭ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন এবং মাস্টারদা সূর্যসেনের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেও সেখানে পড়ালেখা শেষ করেননি, এবং জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের অধীনে পিএইচডি শুরু করলেও তা আর শেষ করা হয়ে ওঠেনি। আহমদ ছফা এর বই সমূহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাঠকদের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বই হিসেবে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। আহমদ ছফা এর বই সমূহের মাঝে 'ওঙ্কার', 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী', 'বাঙালি মুসলমানের মন', যদ্যপি আমার গুরু', 'গাভী বিত্তান্ত' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো জার্মান সাহিত্যিক গ্যাটের অমর সাহিত্যকর্ম 'ফাউস্ট' বাংলায় অনুবাদ করা। আহমদ ছফা এর বই সমগ্র একত্রিত করে রচনাবলি আকারে ৯টি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই সাহিত্যিক 'লেখক শিবির পুরস্কার' ও বাংলা একাডেমির ‘সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার’ পেলেও সেগুলো গ্রহণ করেননি। এই পাঠকনন্দিত সাহিত্যিক ২০০১ সালের ২৮ জুলাই ৫৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মরণোত্তর 'একুশে পদকে' ভূষিত হন।