মনীষী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৭১-১৯৫৩) মধ্যযুগের প্রাচীন পুথি-সাহিত্য আবিষ্কার-সংগ্রহ, পাঠোদ্ধার ও সুসম্পাদনা করে বাংলা সাহিত্যের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনায় গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখেন। জীবদ্দশায় বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগচর্চার প্রবাদ পুরুষে পরিণত হয়েছিলেন। আমৃত্যু বাংলার প্রাচীন পুথি-সাহিত্যই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। তিনি বলতেন‘ তেঁতুল দেখিলে যেমন জিহ্বায় জল আসে, পুথির নাম শুনিলেও আমার তাহা না দেখা পর্যন্ত সোয়াস্তি থাকে না।’ আরেক জায়গায় লিখেন ‘মাছের নামে গাছে হা করে, পুথির নামে আমি হা করি।’ তিনি যদি কঠোর পরিশ্রম ও অদম্য অধ্যবসায়ের সাথে গভীর প্রজ্ঞা-মেধার সমন্বয়ে এসব লুপ্তপ্রায় প্রাচীন সাহিত্যগুলো উদ্ধার না করতেন তাহলে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস অপূর্ণাঙ্গ থেকে যেত। কোন প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া স্ব-উদ্যোগেই মধ্যযুগের প্রায় এগারোশ পুথি-সাহিত্য আবিষ্কার, অনেকগুলো পুথির পাঠোদ্ধার-সম্পাদনা এবং এসব পুথি-সাহিত্যের আলোকে প্রায় চার শতাধিক, কারো কারো মতে ছয় শতাধিক প্রবন্ধ রচনা দ্বারা তিনি বাংলা সাহিত্য ভা-ারকে সমৃদ্ধ করেছেন, বাংলা ভাষা-সাহিত্য ইতিহাসের অনেক অজানা দিক উন্মোচন করেছেন। তাঁর মধ্যযুগের পুথি-সাহিত্য আবিষ্কার দ্বারা বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানদের অবদান এই প্রথম স্বীকৃতি লাভ করে। এতে করে আত্মপরিচয়ের সংকটে দ্বিধাগ্রস্ত দেশজ মুসলমানদের মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব হীনম্মন্যতাবোধ দূরীভূত হয়েছে, স্বকীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। প-িত ড. আহমদ শরীফের মতে ‘আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের অনন্য দান হচ্ছে, আত্মপরিচিতি সম্বন্ধে অনিশ্চিতির দ্বিধা-সংকোচ-সংশয়গ্রস্ত দেশজ বাঙালি মুসলিমদের পনেরো শতক থেকে আঠারো শতক অবধিকালের সাহিত্যে মুসলিম কবির ও কাব্যের সন্ধান দিয়ে তারা যে বাঙালি বাঙলাভাষী সে সম্বন্ধে নিঃসংশয় প্রত্যয়ী করে তোলা।’ (ডায়েরি ভাব-বুদ্বুদ)