‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা সত্যবাদীদের সঙ্গে থেকো।’ সাদিকীনের পরিচয় ও সংজ্ঞা বিস্তৃত ও সুগভীর। নবী-রসুলদের পর আলোর পথের দিশারী এ কাফেলা যুগে যুগে মানবতার কা-ারী হয়ে থাকেন। এমন এক কা-ারীর কথা নিয়ে হাজির হয়েছি, যিনি পুরো বাংলাদেশ বরং উপমহাদেশের এক ক্ষণজন্মা অলি ও বিরল বুজুর্গ ব্যক্তিত্ব হযরত মাওলানা আলী আহমদ বোয়ালভী (রহ.)। তাঁর বিশিষ্টতা বর্ণনা ও ভাষায় ব্যক্ত করা সহজ নয়। তাঁর আধ্যাত্মিক জ্যোতি, জ্ঞানগভীরতা, চারিত্রিক মাধুর্য ও অসাধারণ প্রজ্ঞা পরিমাপ করা আমাদের সক্ষমতাকে অতিক্রম করে। তাঁর তুলনা, নমুনা ও পরিচয় কেবলই তিনি। আল্লাহ তাঁর নির্বাচিত বান্দাদের মধ্যে যাঁদেরকে ভাবের খনি ‘জাওয়ামিউল কালিম’ দিয়েছেন তাঁদের পেয়ালা সমুদ্র হয়ে যায়। দুচার বাক্যে হাজার কথার সারবস্তু পুরে দেওয়ার এমন বিরল প্রতিভা স্রেফ আল্লাহপ্রদত্ত! কুতুবে জামান হযরত মাওলানা আলী আহমদ বোয়ালভী (রহ.) ছিলেন এমনই একজন। তিনি কবি ছিলেন না, কথা শিল্পীও না, ছিলেন না বয়ানের বুলবুলি; তবে মস্তবড় দরবেশ ছিলেন। অগ্রন্থিত ছিলো চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় তাঁর বয়ানের মুক্তামালা। সমাজে সর্বগ্রাসী গোমরাহি, অনাচার এবং নিজের ওপর জুলুমের জুলমাত থেকে নিজেকে ও সমাজকে টেনে তুলে আল্লাহ ও রসুলের আলোকিত মহাসড়কের পথ দেখানোর ক্ষুদ্র প্রয়াস হিসেবে কিছু মুক্তোকণা সংরক্ষণ করেছেন দেশবরেণ্য ইসলামি আইনবিদ আল্লামা মুফতি আবদুস সালাম চাটগামী। এসব হীরে-জহরত তাঁর জীবন ও বাণীসম্ভার থেকে নেওয়া। বিজ্ঞ লেখকের উর্দু ভাষায় রচিত পা-ুলিপিকে অত্যন্ত সুন্দর ও মাধুর্যপূর্ণ প্রমিত বাংলায় তরজমা করেছেন সময়ের নন্দিত তরুণ সাহিত্যিক ও গ্রন্থকার মুহাম্মাদ হাবীবুল্লাহ।
মুফতি আবদুস সালাম চাটগামী ১৯৪৩ সালে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার নলদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালে গ্রামে প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে বাবুনগর মাদরাসায় ভর্তি হন। তারপর ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রামের জিরি মাদরাসায় থেকে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন। ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশের প্রথম মুহাদ্দিস আল্লামা আবদুল ওয়াদুদ (রহ.)-এর নির্দেশনাক্রমে তিনি পাকিস্তানের জামিয়াতুল উলুম আল-ইসলামিয়া আল্লামা মুহাম্মদ ইউসুফ বানুরী টাউন করাচিতে ভর্তি হন এবং তৎকালীন মুহাদ্দিস আল্লামা মুহাম্মদ ইউসুফ বানুরী (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে প্রথম বছর তিনি উ”চতর হাদীসশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং পরের বছর ইফতা বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি আল-ফিকহুল ইসলামী নিয়ে পড়াশোনা করেন। হাদীস ও ইফতা বিভাগের শিক্ষা সমাপ্তির পর জামিয়াতুল উলুম আল-ইসলামিয়া আল্লামা মুহাম্মদ ইউসুফ বানুরী টাউনে মুফতি হিসেবে নিয়োগ পান। পরে তিনি এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান মুফতির পদ লাভ করেন এবং দীর্ঘ তিন দশক দায়িত্ব পালন করেন। এ প্রতিষ্ঠানের ইফতা বিভাগে প্রতি বছর ৯ হাজারের বেশি ফতওয়া জমা হত। সেই হিসেবে এ দীর্ঘ সময় তিনি তিন লাখের বেশি লিখিত ফতওয়া সম্পাদনা করেন, যা ওই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে অনন্য নজির স্থাপন করে। এছাড়াও করাচির ঐতিহ্যবাহী আহমদ উসমানী জামে মসজিদের খতীব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালে মুফতি আবদুস সালাম চাটগামী ইসলামি শিক্ষা প্রসারে নিজ দেশে ফিরে আসেন। করাচির বানুরী টাউন থেকে চলে এলেও প্রতিষ্ঠানে অন্য কাউকে প্রধান মুফতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বরং দেশে ফিরেও বিশেষ সম্মাননা হিসেবে মুফতি আবদুস সালাম চাটগামী করাচির উক্ত মাদরাসায় প্রধান মুফতি পদে ছিলেন। এরপর দারুল উলুম হাটহাজারীর পরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)-এর আহ্বানে ২০০১ সালে দারুল উলুম হাটহাজারীয় প্রধান মুফতি হিসেবে যোগদান করেন। আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)-এর মৃত্যুর পর পরিচালনা পরিষদের প্রধান হন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলির মধ্যে রয়েছে, জাওয়াহিরুল ফাতওয়া, আপ কা সুওয়াল আওর উন কা জওয়াব: আহাদীস কী রৌশনী মেঁ (উর্দু), ইসলামী মায়িশাত কে বুনয়াদী উসূল (উর্দু), মুরাওয়াজা ইসলামী ব্যাংকারী (উর্দু), ইসলাম ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে মানব-অঙ্গের ক্রয়-বিক্রয় (বাংলায় অনূদিত), দিলজাগানো সুরভী মলফুযাতে বোয়ালভী (রহ.) ও করোনাকালীন সমস্যা ও তার শরয়ী বিধান ইত্যাদি। ২৯ মুহাররম ১৪৪৩ মোতাবেক ৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ (বুধবার) সকাল সাড়ে ১১ টায় দারুল উলুম হাটহাজারীর পরিচালনা কমিটির পরামর্শ সভায় তাঁকে পরিচালক ঘোষণার অল্পসময়ের মধ্যে আল্লাহর ডাকে সাড়া দেন।