ব্যাপারটা ঠিক কেমন হবে, যখন কারও সাথে কিছু কথা বলার পর আপনি বুঝতে পারছেন, তিনি সত্য বলছেন নাকি মিথ্যা? কোনো একটা ঘটনা ঘটে গেছে। আপনি সে ঘটনার প্রকৃত রহস্য উন্মোচন করতে চান কিংবা প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের দায়িত্বপ্রাপ্ত। সন্দেহভাজন, অভিযুক্ত কিংবা অভিযোগকারীকে আপনি জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। এমতাবস্থায় এমন কিছু মৌলিক সূত্র আছে কি, যা ব্যবহার করে আপনি সত্যের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারেন? এমন কিছু বিষয় আছে কি, যা সত্য বের করতে আপনাকে দারুণভাবে সাহায্য করতে পারে? হ্যাঁ, এমন কিছু মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এই গ্রন্থে এমন কিছু ইস্যু সামনে আনা হয়েছে, যার মাধ্যমে আপনি সত্য উদ্ঘাটনের কাছাকাছি পৌঁছে যেতে পারবেন। আমরা বলছি না, কেবল এই গ্রন্থের আলোকেই সত্যকে নিশ্চিতভাবেই খুঁজে পাবেন। নিঃসন্দেহে একটা ঘটনা অনেকগুলো প্রেক্ষিতের সমন্বয়ে সৃষ্টি। তবে এখানে এমন কিছু বৈজ্ঞানিক ও প্রমাণিত মূলনীতি আলোচিত হয়েছে, যা আপনাকে প্রকৃত ফ্যাক্ট উন্মোচনে দারুণভাবে সাহায্য করবে। মূলত এই গ্রন্থ একটা বৈজ্ঞানিক ফিল্টার, যার মাধ্যমে বক্তার সত্য—মিথ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব। একজন পুলিশ অফিসার তদন্ত করতে গিয়ে বুঝতে পারবে, জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি ব্যক্তির সত্য—মিথ্যা। একজন আইনজীবী বুঝতে পারবে, কাঠগড়া থেকে সত্য নাকি মিথ্যা বয়ান আসছে। একজন বিচারক বুঝতে পারবেন বাদী, বিবাদী কিংবা সাক্ষী সত্য বলছে কি না। একজন পেশাদার উপলব্ধি করবে, অপরপক্ষ থেকে আসা বর্ণনা/জবানবন্দির সত্যতা। এই গ্রন্থ আপনার ভেতরে একটা সফট স্কিল তৈরি করবে। গ্রন্থটি অধ্যয়নের পর আপনি ভেতর থেকেই প্রয়োজনীয় মানুষকে পরখ করার একটা তাড়না অনুভব করবেন। কেউ যখন আপনাকে কিছু বলবে, লিখবে, স্বীকারোক্তি দেবে, তখন আপনি বলতে পারবেনব, লোকটি কতটা সত্য বলেছে, আর কতটা মিথ্যা। গ্রন্থটি লিখেছেন বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান ডিআইজি (লজিস্টিকস) জনাব তওফিক মাহবুব চৌধুরী। গ্রন্থটি লেখার একটা প্রেক্ষাপট আছে। লেখক একজন পেশাদার পুলিশ অফিসার হিসেবে আমেরিকার ভার্জিনিয়ায় অবস্থিত এফবিআই ন্যাশনাল একাডেমিতে ‘তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদ’ বিষয়ে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেখানে বসেই এই বইয়ের আইডিয়া ও ড্রাফট তৈরি করেছেন। এই গ্রন্থে সাহিত্য রসের চেয়ে তথ্যের সম্মিলন দেখবেন বেশি। বইটি পড়ার সময় নিশ্চয় পাঠকবৃন্দ ব্যাপারটা খেয়ালে রাখবেন। একজন তদন্ত বা অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাকে প্রতিনিয়ত মানুষের বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে হয়। এই সত্যতা যাচাইয়ে তিনি নিজস্ব মেধা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান। কিন্তু সব সময় এগুলো কাজে লাগিয়ে বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয় না। কোনো ঘটনা অনুসন্ধানকালে বেশিরভাগ মানুষই সত্য কথা বলে না। অনেক সময় মানুষ নানান তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করে। একটি প্রণালিবদ্ধ, বিজ্ঞানসম্মত ও ব্যাকরণভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানুষের বক্তব্যের সত্য—মিথ্যা নিরূপণ, অতিরিক্ত তথ্য অর্জন এবং অব্যক্ত বা অপ্রকাশিত তথ্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব। এই বিশ্লেষণ পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে প্রশাসন, আইন, বিচার, ওকালতি, তদন্ত ও অনুসন্ধানকার্যে নিযুক্ত ব্যক্তিরা ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেন। সাথে সাথে মানুষের জবানবন্দি বিশ্লেষণ করে অতিরিক্ত তথ্য অর্জন এবং গোপনকৃত তথ্য উদ্ঘাটন করতে পারেন। মানুষের জবানবন্দি বিশ্লেষণ করে সত্য—মিথ্যা নিরূপণ, অতিরিক্ত তথ্য অর্জন এবং গোপনকৃত তথ্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব কেন? তা সম্ভব এজন্য যে, মানুষের উচ্চারিত শব্দ মনের অজান্তে তাদের নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। মানুষ যা জানে, তার ওপর ভিত্তি করে তারা কথা বলে বা লিখে। অনেক সময় মানুষ কিছু কিছু তথ্য প্রকাশ করতে চায় না, তথ্য গোপন রাখার চেষ্টা করে, তবুও মনের অজান্তে বা না বুঝেই তারা অতিরিক্ত তথ্য দিয়ে দেয়। শব্দের বিশ্বাসঘাতকতার নানা সূত্র ধরে কেউ সত্য বলছে, নাকি মিথ্যা বলছে, নাকি তথ্য গোপন করছেন,তা নির্ধারণ করা যায়। আবার মানুষের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে অতিরিক্ত তথ্যও পাওয়া যায়। গবেষণায় বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, যারা সত্য কথা বলে, তাদের শব্দচয়ন, কথা বলার ভঙ্গি ও কৌশল প্রায় এক। আবার যারা মিথ্যা কথা বলে, তাদের শব্দচয়ন, কথা বলার ভঙ্গি ও কৌশলও প্রায় একই। মানুষের উচ্চারিত শব্দ বিশ্লেষণ করে সত্য—মিথ্যা নিরূপণ করা, অতিরিক্ত তথ্য পাওয়া এবং অব্যক্ত বা অপ্রকাশিত তথ্য উদ্ঘাটন করা একটি বিশেষ কৌশল। মানুষ যা বলে, তা বিশ্লেষণ করে সত্য—মিথ্যা নিরূপণের সর্বোৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় পবিত্র বাইবেলে। পবিত্র বাইবেল থেকে জানা যায়, সোলায়মান (আ.) ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ব্যক্তিদের একজন। তিনি বাদশাহও ছিলেন। তাঁর শাসনকালে একটি শিশুর মাতৃত্বের মালিকানা নিয়ে দুজন মহিলার মধ্যে বিরোধ বাধে। আত্মীয়স্বজন ও পাড়া—প্রতিবেশী নিষ্পত্তি করতে না পারায় বিরোধটি সোলায়মান (আ.)—এর দরবার পর্যন্ত গড়ায়। সোলায়মান (আ.) অভিযোগটি শুনে শিশুটিকে তলোয়ার দিয়ে দুই ভাগ করে দুই মহিলার মধ্যে বণ্টন করে দেওয়ার জন্য জল্লাদকে নির্দেশ দেন। তখন দুজন মহিলার মধ্যে একজন চিৎকার দিয়ে বলে, শিশুটি তার নয়। সে শিশুটিকে হত্যা না করে অন্য মহিলাকে দিয়ে দিতে বলে। সোলায়মান (আ.) তখন নিশ্চিত হন, এই মহিলাই হচ্ছে শিশুটির আসল মা। কারণ, সে চাচ্ছে শিশুটি না মরে অন্য মহিলার নিকট লালিত—পালিত হয়েও বেঁচে থাকুক। সোলায়মান (আ.) তখন শিশুটিকে তার প্রকৃত মায়ের নিকট হস্তান্তর করেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মিথ্যুক মা যদি একই সঙ্গে চিৎকার দিয়ে শিশুটিকে না মারার জন্য বলত এবং শিশুটিকে অপর মায়ের নিকট দিয়ে দিতে বলত, তখন সোলায়মান (আ.) বিরোধটির নিষ্পত্তি কীভাবে করতেন? তিনি হয়তো ভুল মায়ের নিকটই শিশুটিকে হস্তান্তর করে ফেলতেন! পূর্বেই বলেছি, সোলায়মান (আ.) ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী ও বিচক্ষণ ব্যক্তিদের অন্যতম। তিনি তলোয়ার দিয়ে শিশুটিকে দুই ভাগ করার নাটক সাজানোর পূর্বেই দুই মহিলার জবানবন্দি বিশ্লেষণ করে বুঝতে পেরেছিলেন, শিশুটির প্রকৃত মা কে! কী সেই দুটি জবানবন্দি? তলোয়ার দিয়ে শিশুটিকে দুই ভাগ করার নাটক সাজানোর আগে সোলায়মান (আ.) তাঁর দরবারে বসে দুই মহিলার বক্তব্য শুনছিলেন। তাদের মধ্যে বাদানুবাদের একপর্যায়ে এক মহিলা চিৎকার করে বলে, ‘জীবিত বাচ্চাটি আমার আর মৃত বাচ্চাটি তোমার।’ অন্য মহিলা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলল, না না, মৃত বাচ্চাটি তোমার আর জীবিত বাচ্চাটি আমার।’ (নিম্নরেখাঙ্কিত শব্দসমূহের সাজানোর ক্রম খেয়াল করুন।) মহিলা দুজনের বক্তব্য শুনে সোলায়মান (আ.)—এর খটকা লাগল। আপাতদৃষ্টিতে মহিলা দুজন একই কথা বলছে বলে মনে হলেও দুজনের কথায় খুব সূক্ষ্ম একটি পার্থক্য আছে। এক মহিলা বলছে, জীবিত বাচ্চাটি আমার আর মৃত বাচ্চাটি তোমার’, আর অন্য মহিলা বলছে, মৃত বাচ্চাটি তোমার আর জীবিত বাচ্চাটি আমার।’ অর্থাৎ দুই মহিলা ‘জীবিত’ ও ‘মৃত’ শব্দ দুটো আলাদা ‘ক্রম’—এ সাজিয়েছে। এক মহিলা জীবিত বাচ্চাটির কথা প্রথমে বলেছে এবং মৃত বাচ্চাটির কথা পরে বলেছে। অন্য মহিলা মৃত বাচ্চাটির কথা প্রথমে বলেছে এবং জীবিত বাচ্চাটির কথা পরে বলেছে; যদিও তারা উভয়েই জীবিত বাচ্চার মালিকানা দাবি করছে। সোলায়মান (আ.) চিন্তা করলেন, জীবিত ও মৃত বাচ্চা দুটির কথা ওই দুই মহিলা যে ‘ক্রম’—এ সাজিয়েছে, সেভাবেই বাচ্চা দুটির প্রতি তাদের আবেগ প্রকাশ পেয়েছে। যে মহিলা জীবিত বাচ্চাটির কথা আগে বলেছে, সে দ্রুত তার বাচ্চা ফেরত পাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব ছিল। আর যে মহিলা মৃত বাচ্চাটির কথা প্রথমে বলেছে, তার বাচ্চাটি কয়েক ঘণ্টা পূর্বে মারা যাওয়ায় তার মন ভারী ছিল এবং মনের অজান্তেই সে মৃত বাচ্চাটির কথা আগে বলে বসেছে। সোলায়মান (আ.) বুঝতে পারলেন, যে মহিলা জীবিত বাচ্চার কথা আগে বলছে, সেই মহিলাই জীবিত বাচ্চাটির ‘প্রকৃত মা’। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি বাচ্চাটিকে দুই ভাগ করার নাটক সাজিয়েছিলেন মাত্র! বিচক্ষণতার সাথে সোলায়মান (আ.)—এর ন্যায়বিচার প্রদানের এই ঘটনা প্রমাণ করে, মানুষের ‘উচ্চারিত শব্দ’ বিশ্লেষণ এবং তা পরীক্ষা—নিরীক্ষা করে সত্য—মিথ্যা নিরূপণ সম্ভব। মানুষের উচ্চারিত শব্দ বিশ্লে¬ষণ করে সত্য—মিথ্যা নিরূপণ করার মূল ভিত্তি হলো, ‘মানুষের উচ্চারিত শব্দ মনের অজান্তেই তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।’ ওই মিথ্যুক মহিলার ক্ষেত্রেও তা—ই ঘটেছিল। মানুষের উচ্চারিত শব্দ বা লিখিত বক্তব্য বিচার—বিশ্লেষণ করে কীভাবে সত্য—মিথ্যা নিরূপণ করা যায় এবং অতিরিক্ত তথ্য উদ্ঘাটন করা যা, তা বাস্তব ঘটনা, বিভিন্ন উদাহরণ ও অভিজ্ঞতার আলোকে এই বইয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
পেশাদার জীবনে পুলিশ কর্মকর্তা। জন্ম ১৯৭০ সালে সিলেট শহরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন অর্থনীতিতে। ১৫তম বিসিএস-এর মাধ্যমে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনির কসভো ও সুদান মিশনে ইউএন পুলিশ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভার্জিনিয়ায় ইউএস-এর এফবিআই ন্যাশনাল একাডেমিতে তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। কর্মজীবনে লেখক বরিশাল ও রাজশাহী জেলায় পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে ডিসি ডিবি-দক্ষিণ ও ডিসি ওয়ারী, চট্রগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে ডিসি হেডকোয়ার্টার্স এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চে বিশেষ পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত ডিআইজি ছিলেন। বর্তমানে ডিআইজি হিসেবে কর্মরত। পেশাদার জীবনের পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তির জগতেও তিনি বিচরণ করেছেন সচেতনভাবে। অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে চান প্রজন্মের মানসপটে। 'আমি জানি তুমি মিথ্যা বলছ' তার প্রথম গ্রন্থ।