১৭৯২ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি প্যারিসের একটি থমথমে গ্রীষ্ম সন্ধ্যা। রাস্তায় জনতার প্রচণ্ড ভীড়। হোটেল ডি ভীলের ছাদের উপর প্রকাণ্ড ঘণ্টাটি ক্রমাগত বাজিয়া প্যারিসের জনতাকে রাস্তায় বাহির হইয়া আসিতে আহ্বান জানাইতেছে। সমগ্র প্যারিস উত্তেজনায় ফাটিয়া পড়িবার উপক্রম হইয়াছে। খবর আসিয়াছে প্রাশিয়ার নেতৃত্বে সারা ইয়োরোপের নৃপতিগণ সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া প্যারিস অভিমুখে অভিযান শুরু করিয়াছে, ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুইকে জাতীয় আইন পরিষদের সকল নিয়ন্ত্রণ হইতে মুক্ত করিয়া বুর্বন রাজশত্রুকে পুরাতন মহিমায় পুনরায় প্রতিষ্ঠা করিতে। জাতীয় আইন পরিষদ ভবনের সম্মুখে উত্তেজিত জনতার সমাবেশে তিল ধারণের স্থান নাই। ভিতরে জেকোবিন দলের তিন প্রধানের ( রোবসপীয়র, মারাট, ড্যান্টন) অন্যতম, বিচার দফতরে ... এবং অন্তবর্তীকালীন সরকারের নেতা ড্যাণ্টন বক্তৃতা করিতেছেন : ইউরোপের নৃপতিগণ! আমাদের মহান বিপ্লবের, ফরাসী জাতির অস্তিত্বকে মুছিয়া ফেলিবার জন্য তোমরা অস্ত্র ধারণ করিয়াছ। তোমাদের চ্যালেঞ্জ আমরা গ্রহণ করিলাম। আমাদের বিরুদ্ধে তোমাদের জঘন্য মিথ্যা প্রচারের জবাব আমরা নির্ভেজাল, উলঙ্গ সত্যের মাধ্যমেই দিব। তোমাদের পেশাদার সেনাবাহিনীর উন্নততর অস্ত্রসজ্জ ও রণকৌশলের মোকাবিলা আমরা করিব ফ্রান্সে জনতার দেশ প্রেমের দ্বারা যে দেশপ্রেম দেশীয় সামন্ত প্রভূত্বের সমর্থনে বিদেশীর হামলার বিরুদ্ধে ফরাসী জনতার মনে বিক্ষোভের দাবানল সৃষ্টি করিবে, উদ্বুদ্ধ করিবে ফ্রান্সের প্রতিটি সক্ষমদেহী মানুষকে তাহার প্রিয় স্বদেশভূমির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য অস্ত্র ধারণ করিতে, দ্বিধাহীন চিত্তে প্রাণ বিসর্জন দিতে। ফ্রান্সের জনগণ! আমাদের পবিত্র পিতৃভূমি আজ বিপন্ন। অস্ত্র ধর। যুদ্ধে চল। রাজার জন্য নহে, ধর্মের জন্যও নহে, জন্মভূমির আজাদীকে রক্ষার জন্য, সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার আদর্শকে বাঁচাইবার জন্য। প্রাশিয়ান সেনাপতি ব্রাঞ্জউইকের ডিউক! তুমি হুমকি দিয়াছ ‘রাজা ষোড়শ লুইয়ের একটি কেশ স্পর্শ করিলে প্যারিসকে ধুলায় মিশাইয়া দিবে, আমাদের সকলকে ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলাইবে।’ তোমাদের সকল হুমকির জবাব আমরা দিব আমাদের হৃদয় মন হইতে সকল শঙ্কা নিঃশেষে মুছিয়া ফেলিয়া, ‘সাহস- আরও সাহস, আরও, আরও সাহস এই রণধ্বনির দ্বারা।’ অল্পক্ষণের মধ্যেই জাতীয় আইন পরিষদে ড্যাণ্টনের বক্তৃতার মর্ম সারা প্যারিসে ছড়াইয়া পড়িল। হোটেল ডি ভীলের ঘণ্টা অবিশ্রান্তভাবে বাজিতে লাগিল। রাস্তায় বাহির হইয়া আসিতে শুরু করিল, জলন্ত মশাল হস্তে প্যারিসের বস্তিগুলি খালি করিয়া হাজারে হাজারে মানুষ। মশালের আলোয় মনে হইতে লাগিল আগুন লাগিয়াছে প্যারিস মহ-নগরীতে। সেদিন সন্ধ্যায় প্যারিসের সাধারণ মানুষের মনে আগুন সত্যই লাগিয়াছিল; গর্জিয়া উঠিয়াছিল প্যারিসের বাস্তিল-বিজয়ী ভুখা-নাঙ্গা জনতা, রুশো-ভলচেয়ার মণ্টেঙ্কুর মন্ত্র-শিষ্য মুক্ত-মন বুদ্ধিজীবী “লুইকে অবিলম্বে সিংহাসনচ্যুত কর।” “অস্ত্র চাই, অস্ত্র চাই। চল, চল-যুদ্ধে চল।” “পবিত্র জন্মভূমির একটি ইঞ্চি জমিও বিদেশীর বুটের স্পর্শে কলঙ্কিত হইতে আমরা জীবন থাকিতে দিব না।” “দীর্ঘজীবী হউক আমাদের মহান বিপ্লব।” “মৃত্যু নাই আমাদের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার আদর্শের।” সমুদ্র-কল্লোলের ন্যায় প্যারিসেও জনতার এই গর্জনের আওয়াজ কাল-বৈশাখীর ঝড়ের বেগে কয়েক দিনের মধ্যেই ফ্রান্সের প্রতি শহর-বন্দর-গ্রামে ছড়াইয়া পড়িল। অযুতকণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হইল: “অস্ত্র চাই, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হউক।” জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের এক এক গভীর রাত্রে মার্সেলিজ বন্দরের নিম্ন মধ্যবিত্ত এলাকার একটি গৃহের কক্ষে মোমবাতির স্বল্প আলোকে অখ্যাতনামা এক কবি রুজেট ডি লিস্লে লিখিয়া চলিয়াছেন: ‘যুদ্ধে চল, যুদ্ধে চল। জন্মভূমির ডাক আসিয়াছে। যুদ্ধে চটল।’ জন্ম নিতেছে দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতীর সঙ্গীত “লা মার্সেলিজ।” পরের দিন রুজেট তার এক সঙ্গীতজ্ঞ বন্ধুকে গানটি পড়িয়া শুনাইলেন। বন্ধু সঙ্গে সঙ্গে বসিয়া গানটিতে সুর দিয়া দিলেন। সেদিনই তাঁহারা সিদ্ধান্ত করিলেন, ... সাহিত্যে গাহিতে পদরজে প্যারিস রওয়ানা হইবেন। সন্ধ্যায় দুই বন্ধু গান গাহিতে গাহিতে মার্সেলিজ বন্দরের রাস্তা দিয়া প্যারিসের দিতে যাত্রা শুরু করিলেন। দুই-চারিজন পথচারী কৌতূহলী হইয়া তাঁহাদের পশ্চাতে পশ্চাতে চলিতে শুরু করিলেন। ইহাদের অনেকেই সেদিন সন্ধ্যায় অপেক্ষমান প্রিয়জনের নিকট আর না ফিরিয়া যাত্রা করিলেন দুই বন্ধু সঙ্গে প্যারিসের পথে “লা মার্সেলিজ” গাহিতে গাহিতে। দেশপ্রেমের, বিপ্লবের পথে নেশা তাহাদের পাইয়া বসিয়াছে। পঞ্চ রঙের নেশার চাইতেও কঠিন এ-নেশা। বাড়বাগ্নিকে নিভানো সম্ভব। কিন্তু মানুষের মনে একবার আগুন লাগিলে ঈস্পিত লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত সে আগুনকে নিভাইবার সাধ্য দুনিয়ার কোন শক্তির নাই- ইতিহাসের ইহাই একটি বড় শিক্ষা। প্রথমে দুই-চারিজন করিয়া, তারপর গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর উজাড় করিয়া বন্যাস্রোতের ন্যায় দলে দলে মানুষ ‘লা মার্সেলিজ’ গাহিতে গাহিতে এই কাফেলায় শামিল হইতে লাগিল। কাফেলা দিবা-রাত্র চলিতেছে-প্রভাতসূর্যের প্রথম কিরণরশ্মি মাতৃস্নেহের ন্যায় তাঁহাদের শিরে ঝরিয়া পড়িতেছে, মধ্যাহ্ন তপনের প্রচণ্ড তাপ তাঁহাদের শত্রুর মোকাবিলা করিবার সঙ্কল্পকে অগ্নি-কঠিন করিতেছে। সন্ধ্যার অস্তগামী সূর্য প্রিয়জনের অপেক্ষমান আঁখিতে তাঁহাদের স্মরণ করাইয়া দিতেছে। গভীর রাত্রিতে অগণিত মশালের আলোকে পথিপার্শের শহর-গ্রামকে জাগাইয়া শ্রান্ত-চরণে কাফেল যখন চলিতেছে, তখন তাহারা নিজ অন্তরের সহিত মুখোমুখী হইতেছে। ভূমিদাস-চাষী-মধ্যবিত্তের কয়েক লক্ষ মানুষের এই কাফেলা সন্ধ্যায় প্যারিস পৌঁছিল তাঁহাদের মশালের আলোকে সারা প্যারিস দিনের আলোয় আলোকিত হইয়া গেল। হোটেল ডি ভীলের ঘণ্টা উন্মত্তভাবে বাজিয়া চলিয়াছে। প্যারিসের জনতার গর্জন মিশিয়া গেল প্যারিসের বাহিরে শহর-বন্দর-গ্রামের অযুত মানুষের কণ্ঠের ‘লা মার্সেলিজ’ সঙ্গীতের ধুয়ার সহীত। টুইলেরিজ রাজ-প্রাসাদের অভ্যন্তরে রাজা ষোড়শ লুইয়ের কর্ণে হোটেল ডি ভীলের ঘণ্টার আওয়াজ, ফ্রান্সের জনতার রণ-সঙ্গীতের সুর যে কিসের বার্তা পৌঁছাইয়া দিয়াছিল, তাহা আন্দাজ করা কঠিন নহে। বস্তুতঃ কেবল ফ্রান্সের নহে, সারা ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের রাজণৈতিক সত্তা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রেরে মৃত্যু ঘণ্টাও সেদিন বাজিয়া উঠিয়াছিল। ঘোষিত হইয়াছিল ধর্ম-নিরপেক্ষ জাতীয় রাষ্ট্রের জন্ম; সূচিত হইয়াছিল গণতন্ত্র, সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার আদর্শের জয়। কেবল ইউরোপে নহে, সারা দুনিয়ায় সামন্ত-শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আলোকবর্তিকা হিসাবে ফরাসী বিপ্লব কাজ করিয়াছে। এখনও যে সব দেশে সামন্ততন্ত্রের অবসান হয় নাই, সে সব দেশের মানুষকে ফরাসী বিপ্লবের আদর্শ অনুপ্রাণিত করিতেছে। ১৭৯২ খৃষ্টাব্দের ১০ই আগষ্ট প্যারিসে জনতার অভ্যুত্থানের মুখে টুইলেরিজ রাজপ্রাসাদের লুইস গার্ডদের প্রতিরোধ ভাঙ্গিয়া পড়িল এবং ষোড়শ লুই জাতীয় আইন পরিষদে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। ফ্রান্সের সীমান্তের দিকে তখন প্রাশিয়ান জেনারেল ডিউক অব ব্রাঞ্জউইকের নেতৃত্বে ইয়োরোপের রাজন্যবর্গের সম্মিলিত সেনাবাহিনী আগাইয়া আসিতেছে। কোনরূপ আপোষের দিকে না গিয়া ফরাসী জাতীয় আইন পরিষদ জেকোবিন দলের নেতৃত্বে একের পর এক আইন ঝড়ের আগে পাস করিয়া চলিল-কোনরূপ ক্ষতিপূরণ না দিয়া সামন্ততান্ত্রিক অধিকার কায়েমী স্বার্থকে বিলুপ্ত করিয়া দিয়া রাজা ষোড়শ লুইকে বন্দীশালায় প্রেরণ করিল। ড্যাণ্টনের নেতৃত্বে গঠিত অন্তবর্তীকালীন সরকার সকল নাগরিককে অস্ত্রসজ্জিত করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়া স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন শুরু করিলেন। স্বেচ্ছাসেবকদের প্রত্যেকের হাতে একটি করিয়া বন্দুক ও কয়েক রাউণ্ড গুলী দিয়া সীমান্ত অভিমুখে পাঠাইয়া দেওয়া হইল ইহাদের অধিকাংশই জীবনে এই প্রথম বন্দুক হাতে লইয়াছেন ভালমী নামক স্থানে এই স্বেচ্ছাবাহিনীর সহিত তৎকালীন ইউরোপের সর্বাপেক্ষা সুশিক্ষিত ও সুসজ্জিত পেশাদার প্রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সাক্ষাৎ ঘটিল। ডিউক অব ব্রাঞ্জউইক ও তাঁহার সেনাবাহিনী অবাক বিস্ময়ে দেখিলেন বেয়নেটের আগায় “সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা” লেখা কাগজ গাঁথিয়া যুদ্ধশাস্ত্রের, সমর-কৌশলের কোন নীতির ধার না ধারিয়া ইউনিফর্ম দূরে থাকুক, পায়ে জুতা পর্য্যন্ত নাই এমন এক অদ্ভুত ‘সেনাবাহিনী’ গান গাহিতে গাহিতে তাহাদের দিকে দ্রুত আগাইয়া আসিতেছে। একদিকে ফরাসী বিপ্লবের গণতন্ত্রের ভাগ্য এবং অপর দিকে ইউরোপের সামন্ততন্ত্রের ভবিষ্যৎ ভালমীর রণাঙ্গনে সেদিন নির্ধারিত হইয়া গেল। ফরাসী গণবাহিনীর সেই অগ্রগতির সম্মুখে প্রামিয়ান সেনাবাহিনী ধুলার ন্যায় উড়িয়া গেল। আদর্শে অনুপ্রাণিত জনতার অভিযানের মুখে যে পেশাদার সেনাবাহিনীর কোন গুণ-চাতুর্য শেষ পর্যন্ত টিকিতে পারে না, ইতিহাসের এই আর একটি বড় সত্য সেদিন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হইল। এ সত্য ভালমীর পরেও অনেক দেশে বারবার প্রমাণিত হইয়াছে। আলজিরিয়ার জনতার মৃত্যু-পণ আজাদী সংগ্রামকে অমানুষিক বর্বরতার সহিত পিষিয়া মারিবার চেষ্টা করিয়া ফ্রান্সের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী, ছাত্রীবাহিনীর ডালকুত্তার দল ফরাসী বিপ্লবের কালজীয় আদর্শের প্রতিই বিশ্বাসঘাতকতা করিতেছেন, ইতিহাসের অমোঘ বিধানের বিরুদ্ধে গিয়া ও তাঁহারা শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সেরই সর্বনাশ ডাকিয়া আনিতেছেন। ১৭৯২ সাল নহে, ১৯৫৪ সালের শীতের একটি সন্ধ্যা। কেবল কাল নহে, স্থানেরও পরিবর্তন- ফ্রান্সে নহে, সুইজারল্যাণ্ডের লুসেন শহরের একটি ক্যাফে। নয়জন লোক একটি টেবিলের চারিপাশে বসিয়া অনুচ্চস্বরে আলাপ করিতেছেন। আলোচনা শেষ হইয়া আসিয়াছে। নয়জনের একজন বলিতেছেন ঃ “১৮৪২ সাল হইতে ফ্রান্স আমাদের বুকের উপর জগদ্দল পাথরের ন্যায় চাপিয়া রহিয়াছে। একশত দশ বছরের আলজিরিয়া শ্মশানে পরিণত হইয়াছে। আমাদের সংস্কৃতিক-ঐতিহ্যকে ধ্বংস করা হইয়াছে, অর্থনৈতিক দিক দিয়া আমাদের গোলামে পরিণত করা হইয়াছে। রাজনৈতিক দিক দিয়া আমরা ফ্রান্সেরই অঙ্গ-এ প্রহসনের অর্থ হইল আমাদের বানরের মর্যাদা দেওয়া। নিজের দেশে আমাদের নিজের ভাষা ব্যবহার করার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। ফরাসী ভাষাই রাষ্ট্রভাষা- কোর্ট-কাচারী হইতে শুরু করিয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্র সর্বত্রই ফরাসী ভাষার দোর্দাণ্ড প্রতাপ। শিক্ষালাভের সুযোগই আমাদের দেওয়া হয় না। এক কোটি আড়াই লক্ষ আমাদের লোকসংখ্যা। এর মধ্যে সাড়ে বারো লক্ষ মাত্র ফরাসী। অথচ ফরাসীরাই আমাদের আবাদযোগ্য জমির শতকরা আশি ভাগের মালিক, ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্পে ফরাসীদেরই একচেটিয়া অধিকার। এক কথায় মানুষের মত বাঁচিবার সকল অধিকার আমাদের কাড়িয়া লওয়া হইয়াছে। ফরাসীরা আমাদের মানুষ বলিয়াই যে মনে করে না, প্রতিদিন ছোট-বড় হাজার অপমানের মধ্য দিয়া তাহা প্রমাণিত হইতেছে। আমাদের মধ্যে অনেকেই ফরাসীদের সহিত সর্বপ্রকারে সহযোগিতা করিবার চেষ্টা সকলভাবেই করিয়াছেন। ফরাসী সভ্যতা-সংস্কৃতি, ফরাসী বিপ্লবের ঐতিহ্যের প্রতি তাঁহাদের অনুরাগ আন্তরিক! তাঁহারা ফরাসী সভ্যতাকে শ্রেষ্ঠতর মনে করিয়া মনে-প্রাণে নিজেদের ফরাসী করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। ইহারা ভুলিয়া গিয়াছেন যে ১৭৮৯-৯৩ সালের বিপ্লবী ফ্রান্স ও আজিকার সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্সের মধ্যে আসমান-জমিন তফাৎ। সাম্য,মৈত্রী, স্বাধীনতার বদলে নির্মম শোষণ ও শাসনই বর্তমান ফরাসী শাসকগোষ্ঠীর নীতি ও আদর্শ। অমানুষিক নাৎসী অত্যাচারের অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও ফ্রান্সের শাসকগোষ্ঠীর হৃদয়-পরিবর্তন ঘটে নাই। বরং নাৎসী জুলুমের টেক্নিককে আরও উন্নত, আরও বীভৎস করিয়া ইহারা তাহাদের উপনিবেশগুলিকে দাবাইয়া রাখিবার জন্য ব্যবহার করিতেছে! আলজিরিয়ার পরিস্থিতি আজ এমন দাঁড়াইয়াছে যে, আবেদন-নিবেদনের থালা বহিয়া ফরাসীর অনুগ্রহ লাভের নিষ্ফল প্রয়াসের অপমান সহ্য করা আর দেশ ও জাতির প্রতি সজ্ঞানে বিশ্বাসঘাতকতা করা একই ব্যাপার। সুতরাং, আমি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব করিতেছি, আমাদের এক কোটি মানুষের তরফ হইতে আমরা এই নয়জনই ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিলাম। দেশের মানুষকে আমি চিনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, সারা দেশ ফরাসীর একশত বৎসরের অত্যাচারে আজ বারুদাগারে পরিণত হইয়াছে। আমাদের এই যুদ্ধ ঘোষণা সারা দেশের মানুষের মনে আগুন ধরাইয়া দিয়া যে বাড়বাগ্মিতা সৃষ্টি করিবে, তাহাদে ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের সকল নাম-নিশানা নিঃশেষে পুড়িয়া ছাই হইয়া যাইবে।” কথাগুলি বলিতেছিলেন বেন বেল্লা। বেন বেল্লা বর্তমানে ফরাসী কারাগারে বন্দী। সপ্তাহ দুয়েক আগে ফরাসী জেলে আলজিরীয় বন্দীদের রাজবন্দীর মর্যাদা দানের জন্য বেন বেল্লা যে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন, পনর হাজার আলজিরীয় বন্দী উহাতে যোগদান করেন। বেন বেল্লার কথা শেষ হইয়া যাওয়ার পর কয়েক মিনিট কাহারও মুখে কোন কথা নাই। তারপর একে একে বাকী আটজন বলিলেন, ‘তাই হোক’। এই নয়জনের মধ্যে পাঁচজন আজাদী সংগ্রামে শহীদ হইয়াছেন, তিনজন ফরাসী কারাগারে বন্দী। মাত্র একজন-বেল কাসেম ফরাসী জেল ও বুলেটকে এড়াই আলজিরীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দিতেছেন। বছর দুয়েক পূর্বে মার্কিন পত্রিকা ‘টাইমে’র প্রতিনিধির সহিত এক সাক্ষাৎকারে বেল কাসেম বলেন ঃ “লুসেনের সেই শীতের সন্ধ্যায় যখন আমরা নয়জন ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, তখন মনে মনে কিন্তু আমি বেন বেল্লার সহিত পুরোপুরি একমত হইতে পারিতেছিলাম না। আমার ভয় ছিল এক মাস, দুই মাসের বেশী আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামে স্থায়ী হইবে কিনা। কিন্তু বেন বেল্লাই ঠিক ছিলেন। আপনি দুনিয়াকে আজ জানাইয়া দিতে পারেন যে, প্রয়োজন হইলে একশ বছর ধরিয়া আমাদের সংগ্রাম আমরা চালাইয়া যাইতে পারিব। আমরা নয়জন যখন সশস্ত্র সংগ্রামের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, তখন আমরা সকলেই নিঃশব্দে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করিয়াছিলাম যে, হয় আমাদের প্রিয় জন্মভূমি ‘আলজিরিয়াকে’ আজাদ করিব, নতুবা মৃত্যুবরণ করিব। আজ এই প্রতিজ্ঞা এক কোটি আলজিরীয়ানের ।” ১৯৫৪ সালের সেই শীতের সন্ধ্যার পর সাত বছর চলিয়া গিয়াছে। এই সাত বছর ধরিয়া আলজিরিয়ার আজাদী আন্দোলন রক্তের অক্ষরে যে ইতিহাস লিখিয়া চলিয়াছে, তাহার তুলনা খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। অত্যাচারের, হিংস্রতার যে অধ্যায় ফরাসী শাসকগণ, বিশেষ করিয়া ছাত্রীবাহিনী রচনা করিয়াছে, তাহার পূর্ণ বিবরণ এখনও বাহিরের দুনিয়ার জানা নাই। সংবাদ-পত্রের পৃষ্ঠায় অতি সংক্ষিপ্ত ভাবে মাঝে মাঝে যাহা প্রকাশিত হয়, তাহাতেই মমূষ্যত্ব যাহার সম্পূর্ণ লোপ পায় নাই, তাহারই .. শিহরিয়া না উঠা অসম্ভব। সাত বছরে দশ লক্ষ আলজিরিয়ানকে ফরাসীরা হত্যা করিয়াছে, ইহাই বড় কথা নহে। জমিলা বুইরহেডের উপর যে অকথ্য অত্যাচার ফরাসী ছত্রীবাহিনী করিয়াছে, তাহার তুলনায় জোয়ান অব .. ইংরেজদের পুড়াইয়া মারা কিছুই নহে। শিশুকে ইহারা আছড়াইয়া মারিয়াছে, জীবন্ত মানুষকে ইহারা কাটিয়া টুকরা টুকরা করিয়াছে, রুটির দোকানের মালিককে ইহারা তাহারই তন্দুরে জীবন্ত দগ্ধ করিয়াছে। একটি শোভাযাত্রার উপর মেশিন গানের গুলি চালাইয়া ইহারা দুই হাজার লোককে একেবারে হত্যা করিয়াছে। এই সব অত্যাচার আলজিরিয়ানদের আজাদী লাভের সঙ্কল্পকে আরও বজ্রকঠিন করিয়া তুলিয়াছে, দাঁতের বদলে দাঁত লইতে তাহাদের দক্ষ করিয়া তুলিয়াছে। আলজিরীয় মুক্তিফৌজ আজ আর নিছক সন্ত্রাসবাদী দল নহে, রীতিমত একটি বিরাট সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী। স্বাধীন আলজিরীয় সরকার আজ পাকিস্তানসহ পৃথিবীর অনেকগুলি সরকারের স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে। রাজধানী আলজিরিয়ার্সে ফরাসী শাসন কর্তৃপক্ষের চোখের উপর স্বাধীন আলজিরীয় সরকারের পতাকা প্রায় প্রতিটি আলজিরীয় গৃহের উপর সগর্বে উড়িতে থাকে। ফরাসী সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক গোঁড়া ফ্যাসিষ্টপন্থী অফিসার ও আলজিরিয়ার ফরাসী কলোনদের একাংশ ব্যতীত কেহই বিশ্বাস করে না যে, আলজিরিয়ায় ফরাসীগণ আর বেশীদিন টিকিয়া থাকিতে পারিবে। প্রায় এক বছর পূর্বে হেনরী এলেগের বইটি যখন একজন বন্ধুর নিকট হইতে লই তখন তিনি মন্তব্য করিয়াছিলেন, ‘বইটি পড়িবার পর কয়েকদিন ঘুমাইতে পারিবে না।’ কথাটি বিশ্বাস করি নাই। মানুষের উপর মানুষের জুলুম যে কত জঘন্য হইতে পারে, সে সম্বন্ধে কিছু বই ও দলিল পড়া আছে। কিন্তু সত্যই এলেেগর বইটি পড়িবার পর কয়েকদিন ঘুমাইতে পারি নাই। বইটি একটানা ভাবে পড়িয়া যাইতেও পারি নাই। কয়েক পৃষ্ঠা পড়িবার পরই থামিতে হইয়াছে। এতটা বর্বরতার জন্যে মন সত্যই প্রস্তুত ছিল না। বইটি পড়িবার পর সব কিছু ছাপাইয়া দুইটি সত্য পুরোপুরি উপলব্ধি করি। প্রথমতঃ, আদর্শের জন্য অত্যাচার সহ্য করিবার ক্ষমতা মানুষের সত্যিই অপরসীম। দ্বিতীয়তঃ, হেনরী এলেগের জিজ্ঞাসার উত্তর তিনি নিজেই দিয়াছেন। এলেগ তাঁহার বইটির নাম দিয়াছেন ‘দি কোশ্চেন’। প্রথমে আমার মনে হইয়াছিল ছত্রীবাহিনী তাঁহাকে তিন মাস ধরিয়া দিনের পর দিন ক্রমাগত প্রশ্ন করিয়া যাওয়াতেই তিনি বইটির নাম দিয়াছেন ‘কোশ্চেন’, কিন্তু বইটি পড়া শেষ করিয়া প্রকৃতিস্থ হইবার পর বুঝিলাম, এলেগ তাঁহার লোহমর্ষক অভিজ্ঞতার বিবরণের মাধ্যমে ফরাসী জাতির অন্তরের নিকট একটি বিরাট ও মৌলিক ‘জিজ্ঞাসা’ উত্থাপন করিয়াছেন। ফরাসী বিপ্লবের সকল ঐতিহ্য, মানবিক মূল্যবোধের সকল চিহ্ন ফরাসী জাতির অন্তর হইতে মুছিয়া গিয়াছে কিনা, ইহাই এলেগের ‘জিজ্ঞাসা’। কেবল ফরাসী জাতির নিকট কেন সারা দুনিয়ার মানুষকেই এলেগ প্রশ্ন করিতেছেন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে মানুষের উপর মানুষের এইরূপ হিংস্র জুলুম আর কতদিন চলিবে। ছত্রীবাহিনীর অত্যাচার লাঞ্ছনায় আলজিরীয় দেশপ্রেমিকদের সহিত এক কাতারভূক্ত হইয়া এলেগ প্রমাণ করিয়াছেন যে ফরাসী জাতির আত্মা এখনও বিনষ্ট হয় নাই। এলেগের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অডিনকে দুইজন আলজিরীয় দেশপ্রেমিকের সঙ্গে একই সময়ে গুলি করিয়া হত্যা করা হয়। জমিলা বুইরহেডের ন্যায় কয়েকজন ফরাসী বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর একাংশ আজ প্রকাশ্যে আলজিরিয়ার আজাদী আন্দোলনকে সমর্থন; সুতরাং এলেগের ‘জিজ্ঞাসার’ জওয়াব পাওয়া গিয়াছে বলা অন্যায় হইবে না। ফরাসী বিপ্লবের যে ত্রিবর্ণ পতাকা ফরাসী ছত্রীবাহিনী কর্তৃক কলঙ্কিত হইয়াছে, আলজিরিয়ার দেশপ্রেমিকগণ স্বদেশের আজাদীর জন্য মৃতুপণ সংগ্রামের দ্বারা উহাকেই উঁচু করিয়া তুলিয়া ধরিয়াছেন। মার্সেলিজ হইতে যে কাফেলা ১৭৯২ সালে প্যারিসের পথে যাত্রা শুরু করিয়াছিল, আলজিরিয়ার আজ সেই কাফেলারই অবিরাম যাত্রা চলিয়াছে। বেন বেল্লা ও হেনরী এলেগ একই আদর্শের সন্তান। সালান-মাস্যু ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হইবে। এই পৃথিবীর ভবিষ্যতের মালিক এলেগ, বেন বেল্লা, অডিন, জমিলা বুইরহেড। এবং এই ভবিষ্যৎ সুদূর নহে।