পদ্মানদীর মাঝি: পদ্মানদীর মাঝি (১৯৩৬) উপন্যাসে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯০৮—১৯৫৬ খ্রি.) অনুপ্রেরণা কে? সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬—১৯৩৯ খ্রি.), নাকি কার্ল মার্কস (১৮১৮—১৮৮৩ খ্রি.)? এ প্রশ্নের সুরাহা করা শক্ত। সুতরাং এ প্রসঙ্গের অবতারণা মানেই অনর্থক বাক্যব্যয়। মানিকের এই উপন্যাস পড়তে শুরু করলে পাঠকের মনে হয়, ঔপন্যাসিক সম্ভবত পদ্মার তীরবর্তী জেলে ও মাঝি সম্প্রদায়ের নিষ্করুণ জীবনকাহিনি বলতে চলেছেন। পৃষ্ঠা বিশেক পড়বার পর পাঠকের বিভ্রম কাটে। তখন তার মনে হতে থাকে যে, এটি কুবের—কপিলার মনোদৈহিক প্রেমের উপাখ্যান। উপন্যাসের মাঝামাঝি পর্যায়ে গিয়ে— হোসেন মিয়া চরিত্রটির অবস্থান ও বহির্বলয় পাকাপোক্তভাবে আভাসিত হওয়ার পরে— পাঠকের ভাবনা আবার ভিন্ন পথে মোড় নেয়। এ পর্যায়ে পাঠকের মনে হয়, মানিক সম্ভবত মার্কসবাদী কথাসাহিত্য ফাঁদছেন। উপন্যাস পড়া শেষ হওয়ার পরেও পাঠক স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন না— একবার তার মনে হয়, এটি জেলে সম্প্রদায়ের মহাকাব্যিক জীবনালেখ্য; তো পরক্ষণেই তার মনে হয়, এটি আসলে ভগ্নিপতি—শ্যালিকার সমাজনিন্দিত প্রণয়কাহিনি— আবার মার্কসবাদী কথাশিল্পের পণ্ডিতি ছাঁচ ও ছক পাঠককে এমনভাবে ভাবিত করে যে, অমীমাংসিতভাবে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এটি একটি ফরম্যাট—দেওয়া মার্কসীয় গল্প। পদ্মানদীর মাঝি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বাধিক পঠিত, সবচেয়ে বেশি আলোচিত উপন্যাস। প্রান্তিক মানুষের জীবনসংগ্রামকে এই উপন্যাসে তিনি যেমন নির্মাণ করেছেন, তেমনইভাবে, মনোদৈহিক প্রেমের বিচিত্র রূপ—রূপায়ণেও তাঁর পারদর্শিতা অবিসংবাদিত। জেলেজীবনের ইতিকথা এবং স্তরবহুল প্রেমকাহিনিকে ধারণ করেও পদ্মানদীর মাঝিকে মহাকাব্যিক লক্ষণাক্রান্ত আঞ্চলিক উপন্যাস বলাই অধিকতর যুক্তিশাসিত এই কারণে যে, ময়না দ্বীপ কল্পনায় এবং লোকালয়—বিচ্ছিন্ন অভিনব সমাজ—পরিকল্পনায় মানিক সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত। মানিক—পূর্ব বাংলা উপন্যাসের পাঠকেরা ‘ভালো চরিত্র’ এবং ‘মন্দ চরিত্র’— এই দুই ধরনের চরিত্রের সঙ্গেই কেবল পরিচিত ছিল। পদ্মানদীর মাঝিতে মানিকই প্রথম পাঠকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন : মানবচরিত্র দুর্জ্ঞেয়; মানবচরিত্রকে মোটা দাগে ‘ভালো’ কিংবা ‘মন্দ’ তকমা জুড়ে দেওয়া অসংগত— দৃষ্টিভঙ্গিগত ভিন্নতা এবং প্রেক্ষণবিন্দুর অবস্থানগত পার্থক্যের কারণে মানবচরিত্র একেকজনের কাছে একেক রকম। এই উপন্যাসের চরিত্র— কুবের, কপিলা, হোসেন মিয়া তার প্রামাণিক দৃষ্টান্ত।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।