শেষের কবিতা: পাললিক সৌরভ প্রকাশিত চিরায়ত বাংলা গ্রন্থমালা সিরিজে, পাঠক, আপনাকে স্বাগত জানাই। এই মুহূর্তে আপনি হাতে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১—১৯৪১ খ্রি.)এর শেষের কবিতা (১৯২৯) উপন্যাস। বাঙালি পাঠকের কাছে রবীন্দ্রনাথকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ধৃষ্টতার পর্যায়ে পড়ে। তাঁর রচনাভাণ্ডার যেমন বিপুল তেমনই বিচিত্র। ৮০ বছরের দীর্ঘজীবনে তিনি রচনা করেছেন ১৩টি উপন্যাস, ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্য—গ্রন্থ, ৯৫টি ছোটগল্প এবং ১৯১৫টি গান। তাঁর পত্রসাহিত্য ১৯ খণ্ডে এবং চিঠিপত্র ৪ খণ্ডে প্রকাশিত। এ—ছাড়াও তিনি এঁকেছেন প্রায় দুই হাজার ছবি। গীতাঞ্জলি (ইংরেজি নাম : Song Offerings) কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯১৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন— এর কোনো তথ্যই আপনার অজানা নয়। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলোর মধ্যে শেষের কবিতা বিশ্বমানসম্পন্ন, শিল্পসফল ও রসোত্তীর্ণ। রবীন্দ্রনাথের সর্বাধিক পঠিত, জনপ্রিয় উপন্যাস হিসেবেও শেষের কবিতার আলাদা একটি গুরুত্ব আছে। জনপ্রিয় লেখা শিল্পসফল হয়েছে, কিংবা শিল্পসফল লেখা জনপ্রিয়তা পেয়েছে— সমগ্র বিশ্বসাহিত্যে এমন দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই। সংগতকারণে এই প্রশ্ন উঠতেই পারে : শেষের কবিতায় এমনটি ঘটার রহস্য কী? প্রবীণ পণ্ডিতেরা এ—বিষয়ে মুখ খোলেননি। অর্বাচীন পাঠক হিসেবে আমার কাছে মনে হয় : রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই উপন্যাসে প্রেম এবং তত্ত্ব— সর্বদা বিপরীতমুখী এই দুটি বিষয়কে একসূত্রে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। সেই সাথে উপন্যাসের ফর্মের সাথে মিশেল দিয়েছেন কবিতার প্যাটার্ন— আর কী লাগে? এ উপন্যাসে অমিত ও লাবণ্য একে অপরকে ভালোবাসে, কিন্তু অমিত বিয়ে করে কেতকীকে, লাবণ্যের বিয়ে হয় শোভনলালের সাথে। প্রেম এবং পরিণয়ের মতো ভয়াবহ সাংঘর্ষিক দুটি পর্যায়ে তাদের ভালোবাসা শেষ পর্যন্ত অটুট থাকে। আপনার কিংবা আমার মতো গড়পরতা লোকের কাছে বিচ্ছেদ সর্বদা দাহ এবং বেদনার— অমিত ও লাবণ্যের ক্ষেত্রে সেটি ঘটতে দেখি না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর যে ‘প্রেটোনিক লাভ থিয়োরি’র জন্য বিখ্যাত, তার এক অনবদ্য প্রকাশ এ উপন্যাসে ঘটতে দেখি। শেষের কবিতা উপন্যাসের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ যেন বলতে চেয়েছেন : প্রেম করে বিয়ে করতে নেই। প্রেম যখন পরিণয়ে গড়ায়, প্রেমিক—প্রেমিকা যখন স্বামী—স্ত্রী হিসেবে যৌথজীবন শুরু করে, তখন প্রাণী হিসেবে তারা হয়ত বেঁচেই থাকে, কিন্তু তাদের প্রেম যায় মরে। রবীন্দ্রনাথ যেন বলতে চাইলেন, মানসিক প্রশান্তির জন্য প্রেম প্রয়োজনীয়, আর জীবনের আটপৌরে প্রয়োজনে বিয়েটাও দরকারি। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিতে স্ত্রী হচ্ছে ‘ঘড়ায়—তোলা জল’, আর প্রেমিকা হলো ‘দিঘি’। খোদ উপন্যাস থেকে একটুখানি উদ্বৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না। অমিত বলে, ‘কেতকীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ভালোবাসারই; কিন্তু সে যেন ঘড়ায়—তোলা জল, প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যের সঙ্গে আমার যে ভালোবাসা সে রইল দিঘি; সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।’ প্রেমতৃষিত, বিরহলাঞ্ছিত চিরকালের মানব—মানবীর কাছে এ এক প্রশান্তির দর্শন। বিরহদহনে সান্ত্বনার প্রলেপ ভালো লাগারই কথা।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।