বাংলার এই প্রান্তে বিশ শতকে মেধা ও কায়িক শ্রম কোনো কোনো ব্যক্তিকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে যেতে পেরেছে, তার একটি উদাহরণ শ্রীকাইলের কৃতী সন্তান ক্যাপ্টেন ডাক্তার নরেন্দ্রনাথ দত্ত । ক্যাপ্টেন ডাক্তার নরেন্দ্রনাথ দত্তের জীবনেতিহাস যেন এক রূপকথা। শিশুকাল থেকে নিজের শ্রমে উপার্জন, পরিবারে আর্থিক সহায়তা আর নিজের লেখাপড়ার খরচ চালানোসহ নানা বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। সে উদ্দেশ্যে গ্রামের বাজারে মুদি দোকানে কাজ করেছেন, গ্রামের অন্য কৃষকের কামলাদের সাথে জমিতে নিড়ানির কাজ করেছেন । গ্রামের কৈবর্তদের সাথে থেকে জাল টানার কাজ করেছেন । কুমিল্লায় স্কুল কলেজে পড়ালেখার সময় শহরতলির গ্রাম থেকে শাকসবজি কিনে শহরের প্রধান তরকারি বাজার রাজগঞ্জে নিয়ে বিক্রি করে আয়ের মাধ্যমে লেখাপড়ার খরচ যুগিয়েছেন । কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময়েও খরচ চালাতে খিদিরপুর ডকে রাতভর জাহাজে মাল উঠানো থেকে মাল নামানোর মতো শ্রমের কাজ করেছেন একাধারে সাত বছর। জাহাজ সামরিক বাহিনীর ক্যাপ্টেন পদ থেকে তিনি স্বেচ্ছায় অবসর নেন। নিজের অর্জিত অর্থে তিনি ব্যবসা করেছেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়েছেন । তিনি বেঙ্গল ইমিউনিটি কোম্পানির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজের আরও ব্যবসা বাড়িয়েছিলেন যার মধ্যে ভারতী প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং কোম্পানি লি. নবশক্তি নিউজ পেপারস কোম্পানি লি. এস. এটুল এন্ড কোম্পানি লি. প্রভৃতি অন্যতম। বেঙ্গল ইমিউনিটি রিসার্চ ইনস্টিটিউট পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিষ্ঠা করেন; ভারতে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান এটিই প্রথম। তিনি অন্যকেও নানা ব্যবসায়ে পরামর্শ দিয়েছেন। ফলে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। দেশে প্রথমবারের মতো বঙ্গোপসাগরে ট্রলার ভাসিয়ে মাছ আহরণের মাধ্যমে তিনি ফিশিং ব্যবসা চালু করেন। অবিভক্ত বাংলায় ডেভেলপার হিসেবেও তিনিই পথিকৃৎ। তিনি নিজ গ্রামে পিতার নামে শ্রীকাইল কৃষ্ণকুমার উচ্চ বিদ্যালয় এবং কুমিল্লার গ্রামীণ এলাকার প্রথম কলেজ-শ্রীকাইল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতা শহরতলির বরাহনগরেও একটি স্কুল ও ছাত্রাবাস চালাতেন। তাঁর মৃত্যুর পর সেই স্কুলটির নাম হয় নরেন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দির। পরিচ্ছন্ন রাজনীতির আকাঙ্ক্ষা করেছেন জীবনভর। কংগ্রেসের রাজনীতিতে নেতাজীকে সহযোগিতা করেছেন নীরবে । পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের প্রথম মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীর পদ গ্রহণের আহবান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বিনীতভাবে। শিক্ষার প্রতি ছিল তাঁর আজীবন দরদ । তিনি প্রত্যাশা করতেন, দেশের যুবসমাজ যেন প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ গড়ায় আত্মনিয়োগ করে। ক্যাপ্টেন দত্তের জীবনের এসব কথা পাওয়া যায় তাঁর সহাধ্যায়ী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডা. অমূল্যরতন চক্রবর্তীর লেখা ক্যাপ্টেন নরেন্দ্রনাথের জীবন-কথা শীর্ষক বইয়ে। সমাজসেবায় ক্যাপ্টেন ডাক্তার নরেন্দ্রনাথ দত্তের অবদান, শিক্ষা বিস্তারে কলকাতা ও নিজ এলাকায় গড়ে তোলা তাঁর প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান ও এগুলোর সর্বশেষ অবস্থা চিত্রিত করে বিস্তৃত ক্যানভাসে জয়নাল হোসেন নির্মাণ করেছেন একজন ক্যাপ্টেন দত্তের তিন শতাব্দীর গল্প মহান সংগ্রামী, জনদরদি, আত্মোৎসর্গিত এ মনীষীর অনেক অজানা তথ্য আগ্রহী পাঠকের কৌতূহল নিরসনের জন্য এই বইয়ে তুলে ধরায় জয়নাল হোসেন ধন্যবাদাই হয়েছেন।