মুসলমানদের জন্য রাসূলের (সা) সীরাত পাঠ করা অবশ্য করণীয় দায়িত্ব, কেননা সীরাত পড়েই মুসলমানরা বুঝতে পারে যে কিভাবে ইসলামকে তার ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ করতে হয়। আর সেক্ষেত্রে বর্তমান বাস্তবতায় রাসূলের (সা) জীবনের সামরিক কার্যক্রমকে এড়িয়ে না গিয়ে বরং তাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করাটা বেশি প্রয়োজন। প্রশ্ন জাগতেই পারে, বর্তমানে যে সমাজ কাঠামো রয়েছে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা না করে কি আদৌ ইসলামের পুর্নজাগরন ঘটানো সম্ভব? কোনো সমাজকে শত্রুভাবাপন্ন হিসেবে বিবেচনা করা যায় কি? একটি পুর্নজাগরনবাদী আন্দোলন কি শত্রুভাবাপন্ন একটি সমাজে আঘাত না করেই কাজ করতে পারে? ইসলামিক পুর্নজাগরনের জন্য সামরিক শক্তির প্রয়োগকে কতটা সীমিত রাখা যাবে? এই সবগুলো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে রাসূলের (সা) জীবনী থেকে, কেননা তার গোটা জীবনই হলো কুরআনের নীতিমালাকে যথাযথভাবে অনুশীলন করার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। এই ধরনের একটি সীরাত পড়লেই জানা যায় যে, রাসূল (সা) নবুয়্যত লাভের মক্কায় যখন দাওয়াতী কাজ শুরু করলেন, তখন তিনি এবং তার মুসলিম সঙ্গীরা ব্যাপক নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হন। তা স্বত্বেও কোনো সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার অনুমতি তাদেরকে দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে শত্রু পক্ষবেষ্টিত একটি পরিবেশে যখন মুসলমানরা নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলো, তখন পরিস্থিতির আলোকে তাদেরকে যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হলো। এর কয়েক বছর পর আবার যখন মুসলমানরা শক্ত অবস্থায় পৌছে গেলো, তখন তাদেরকে যতদূর সম্ভব যুদ্ধকে পরিহার করে চলার নির্দেশনা দেয়া হলো। এমনকি রাসূল (সা) যখন চ‚ড়ান্তÍভাবে মক্কা বিজয় করলেন, তখন মুসলমানদের সামনে অত্যাচারী কুরাইশ নেতাদের উপর প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ চলে আসলো। কিন্তু তখনও রাসূল (সা) সম্ভাব্য রক্তপাতকে ঠেকানোর জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। গতকাল যারা শত্রু ছিল আজকে তাদেরকেই বন্ধু বানিয়ে নেয়ার জন্য তিনি মুসলমানদের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। ঈমানের উপর ভিত্তি করে তিনি ঘনিষ্ট সম্পর্কের আলোকে তিনি একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন যেখানে সকলেই ভাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকবে। আজকের এই দুনিয়াতে, ইসলামের পৃষ্ঠপোষকেরা ইসলামকে আবারও দিক নির্দেশনা দেয়ার ভূমিকায় দেখতে চান। কেননা তারা বিশ্বাস করেন একমাত্র ইসলামিক অনুশাসনের মাধ্যমেই বিশ্বে আবারও শান্তি ও সুখ নেমে আসতে পারে, বিশ্বের সকল জুলুম ও নিপীড়নের অবসান ঘটতে পারে। আর ইসলামকে সেই রূপে দেখতে হলে মুসলমানদেরকে আবার রাসূলের (সা) সুন্নাহ অনুসরণ করতে হবে। মুসলমানদেরকে অনুধাবন করতে হবে যে, তাদেরকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। এই দায়িত্বের ব্যাপারে তাদেরকে আল্লাহ তায়ালার সামনে জবাবদিহি করতে হবে আর সেই দায়িত্ব হলো বিশ্ব মানবতার সামনে ইসলামের সুমহান বার্তাকে পৌছে দেয়া। যদি মুসলমানেরা এই কাজের বাইরে অন্য কোনো কাজে সম্পৃক্ত হয়ে যায় তাহলে তাঁরা বরং অযাচিত ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। তাদের কাজের যতটুকু ভালো ফলাফল আসার কথা ছিল তাও পাওয়া যাবেনা। আল্লাহ যে নবী রাসূলকে ইতোপূবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন, তাদের উপরও ঠিক এতটুকুই দায়িত্ব ছিল কেননা এর মাধ্যমেই সর্বোত্তম প্রতিফল পাওয়া যাবে। মুসলমান সম্প্রদায়ের বাইরে আরো যতো মানুষ আছে তাদের মধ্যেও ইসলাম সমন্ধে একটি সম্যক ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয় কেননা সঠিক ধারণা থাকলে তারা ইসলাম ও ইসলামের পুনর্জাগরনবাদী আন্দোলনের ব্যপারে নিজেদের মানসিকতা নির্ধারণ করতে পারবে। ফলে তারা বুঝতে পারবে যে, ইসলামের ধারক ও বাহকদের সাথে সহাবস্থান করতে হলে তাদেরকে কি করতে হবে। আর মুক্ত চিন্তা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য পরস্পরের সমন্ধে সঠিক ধারণা রাখার কোনো বিকল্প নেই। কেননা ততটুকু স্বাধীনতা ভোগ করা প্রতিটি মানুষের অলঙ্ঘনীয় অধিকার। ইসলাম এই অধিকারকে অন্য সকল অধিকারের চেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে স্বীকৃতি দেয়। এই দাবীর স্বপক্ষে কুরআনের দুটি আয়াতের উল্লেখ করা যায়। “বস্তুুতঃ ফেতনা ফ্যাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ।” (সূরা আল বাকারা : আয়াত নং ১৯১) এবং “আর দ্বীনের ব্যাপারে ফেতনা সৃষ্টি করা নরহত্যা অপেক্ষাও মহা পাপ।” (সূরা বাকারা : আয়াত ২১৭)। বর্তমান যুগের প্রখ্যাত চিন্তাবীদ ড. এম এইচ খায়াতের মতে, “এই আয়াত দুটি থেকে বোঝা যায় যে, ফ্যাসিবাদ ও ফেতনা ফ্যাসাদ অর্থাৎ যার মাধ্যমে অন্যের স্বাধীনতাকে হরণ করা হয় তা মানুষ খুন করার চেয়েও গুরুতর।” এই মৌলিক নীতিমালার মাধ্যমে আমরা এই চিন্তায় উপনীত হতে পারি যে, মানুষের স্বাধীনতা তার জীবনের চেয়েও মূল্যবান। কেননা স্বাধীনতা থাকলেই মানুষের মানবিকতাগুলো পুরোপুরি বিকশিত হতে পারে।” এই ধরনের স্বাধীনতা ও উদারতাকে স্বীকৃতি দেয় বলেই ইসলাম প্রতিপক্ষকে সম্মানের সাথে মূল্যায়ণ করে এবং ঘোষণা করে যে প্রতিটি মানুষেরই তার পছন্দমত পথকে বেছে নেয়ার সুযোগ আছে। ইসলামের এই দৃষ্টিভঙ্গি থাকার কারণে পশ্চিমা সভ্যতা চাইলেও ইসলামের সাথে সংঘাতে জড়াতে পারেনা। কেননা ইসলামই একমাত্র দ্বীন দর্শন যা সকল মানুষের অবাধ স্বাধীনতা নিশ্চিত করে।