“দুটি বিদ্রোহের কথা" বইটির ফ্ল্যাপ এর লেখাঃ কমরেড বৃন্দাবন সাহা তাঁর রচনাসমূহ পাঁচটি স্বনির্মিত ফুলক্ষেপ কাগজের খাতায় লিখে গিয়েছিলেন। তাঁর জন্ম ১৯১১ সালে। এই লেখাগুলো যখন শেষ করেছেন তখন তাঁর বয়স ৭২ বছরের অধিক। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৯৫ সালের ৮ই মার্চ। বৃন্দাবন সাহার জীবনে রাষ্ট্রকর্তৃক এবং দারিদ্র্যের চরম আঘাতে শারীরিকভাবে ভেঙেই পড়েছিলেন কিন্তু অসামান্য মানসিক শক্তিতে শ্রমসাধ্য স্মৃতির ধূসর অন্ধকার হাতিয়ে লেখাগুলো জীবনের শেষপ্রান্তে এসে লিখেছেন, সেটা বিস্ময়কর বটে। লেখাগুলো সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট স্বীকারোক্তি, 'আমি লেখক নই। বাস্তব ঘটনা যা দেখেছি ও করেছি তা-ই পাঠকবর্গের নিকট তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। যদি কোন ভুল-ভ্রান্তি হয়, কিংবা লেখা আগে-পিছে হয়ে থাকে, সেই ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারি স্টেটের প্রজা-বিদ্রোহের ঘটনা সবিস্তারে লিখেছেন। লিখেছেন নাচোল বিদ্রোহের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। রাজশাহী জেলে ২০ নম্বর সেলে থাকাবস্থায় নাচোল কৃষক বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ঘটনা সবিস্তারে লেখা শুরু ও শেষ করেন। দশ বছর কারাভোগের পর মুক্তি পান। কিন্তু জেল থেকে ওই লেখা নিয়ে বেরুতে পারবেন না ভেবে পুড়িয়ে ফেলেন। পরে রাজশাহী অবস্থানকালে পুনরায় লেখাটি দ্বিতীয় দফায় লেখেন। একস্থান নেতার নিকট লেখাগুলো দেন যাতে প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু প্রকাশ করা তো দূরের কথা লেখাটি নেতা ব্যক্তিটি অবহেলায় হারিয়ে ফেলেন। এজন্য বৃন্দাবন সাহা অত্যন্ত দুঃখ পান এবং ক্রুগ্ধ হন। তাঁর প্রখর স্মৃতিশক্তির কারণেই বৃদ্ধ বয়সে লেখাটি তৃতীয় দফায় সম্পন্ন করেন। নাচোলে কৃষক বিদ্রোহ ও নৃশংস নির্যাতন, জেল জীবন- তাঁর জীবনের দুটি বিদ্রোহের কথা ঠাকুর বাড়ির জমিদার বাড়িতে প্রজাদের, নাচোলে কৃষকদের এতটাই গভীরে প্রোথিত ছিল যে, ওই কারণেই তৃতীয় দফায় লেখাটি লিখে যেতে পেরেছেন। না হলে মোটেও সম্ভব হতো না। নাচোলের কৃষক বিদ্রোহের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের জমিদারি অঞ্চলের বিস্তৃত বর্ণনা পাঠের পর নিশ্চয়ই অনেক অজানা তথ্য-উপাত্ত পাঠকের দৃষ্টিগোচর হবে। নতুন করে ভাবতে সাহায্য করবে। গবেষকেরা এসকল তথ্য নিয়ে গবেষণা করতে পারবেন। রচনাগুলো মতাদর্শিক সামব্রতী ও প্রগতিবাদীদের প্রেরণা দেবে বলেই মনে করি। কমরেড বৃন্দাবন সাহা শেষ পর্যন্ত আর মাতৃভূমিতে থাকতে পারেননি। পাকিস্তানি রাষ্ট্রের প্রধান শত্রু ছিল কমিউনিস্টরা। বৃন্দাবন সাহা দশ বছর কারাভোগের পর দেশে আশানুরূপ মতাদর্শিক রাজনৈতিক শক্তির দুরাবস্থায় ১৯৬০ সালে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। প্রথমে ভারতের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির এবং পার্টির বিভক্তির পর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কুমারগঞ্জ থানা অঞ্চলে পরিশ্রমী, কষ্টসহিষ্ণু, নীতিনিষ্ঠ নেতা হিসেবে আমৃত্যু সক্রিয় দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তাঁর রচনা পাঠকের হাতে তুলে দিতে পেরে গভীরভাবে আত্মতৃপ্তি লাভ করছি। এই গ্রন্থটি এদেশের বাম-প্রগতিশীল রাজনীতিকদের প্রকৃত কমিউনিস্ট হতে এবং প্রগতিবাদী ধারাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।