ভূমিকা কবিতা নিয়ে নতুন কাজ হবে, এটা সফলতার লক্ষণ। আমি একে আমন্ত্রণ জানাই। এতদিনের অভ্যাস কবিতার চেহারা না পাল্টালে, ভাষাকে আমূল বদলে দিতে না পারলে বাংলা কবিতা তার স্বর, সুর হারিয়ে দাঁড়িয়ে পড়বে পূর্ণযতির আকারে। আমাদের ব্যক্তিগত বোধ, পর্যবেক্ষণ, প্রতিবাদ অবশ্যই কবিতার কেন্দ্রে থাকবে। তবে তার সঙ্গে এসে মিশতে হবে একদিকে শেকড় সংলগ্নতা অন্য দিকে বৈশ্বিক বোধ, ইতিহাস সচেতনতা, সমাজ মনস্কতা। ভাষা নিয়ে করতে হবে নিরন্তর পরীক্ষা, এবং সর্বোপরি মানুষের কাছে দায়বদ্ধতা। তা না হলে কবিতা হারিয়ে ফেলবে তার সামাজিক আবেদন। বাড়বে জনবিচ্ছিন্নতা। এই গ্রন্থের জনক কবি দ্বীপ সরকার কবিতার মধ্য দিয়ে নিজেকে জানার জন্য জানালার দু’টি কপাটই খুলে দিয়েছেন দিগন্তের দিকে। বিশ্বাস আর ভালোবাসার কোরক ফাটিয়ে তিনি হতে চেষ্টা করছেন বিচিত্রগামী ও বিশ্বচারী। শাশ্বত চিরন্তন মূল্যবোধের পাশাপাশি তার কবিতায় আমরা দেখতে পাই প্রাচীন শব্দপুঞ্জের ব্যবহার। যা সুন্দর অনুরণন তোলার পাশাপাশি জীবন পদচারণায় কিছুটা হলেও আড়ষ্টতা সৃষ্টি করে! এই যে প্রবীণে-নবীনে সখ্যতা গড়ে ওঠে তার কবিতায় এটা যেন মন্দ-মাদলের সুরসুষমা। প্রায়ই প্রতীকের আচ্ছাদনে তুলে ধরেন তিনি তার বক্তব্য যা শুনতে খুব মসৃণ মনে হয় না। আমি চাই কবিতায় থাকুক প্রতীকের বৈচিত্র্যতা, চিন্তামূলকতা, সাহিত্যের সামগ্রিক ধূসরতা—যা কবিতার নতুন বর্ণ প্রলেপণের তেজ হিসেবে কাজ করে। কবি দ্বীপ সরকার কাব্যের কুহকে প্রবেশ করেছেন সবেমাত্র। ঝিনুকে খাঁটি মুক্তোর আকার নিতে যথেষ্ট সময় দিতে হয়। সইতে হয় বেদনার অনেক বাতাবরণ। শর্ট সিলেবাসের সংবিধান এখানে এখতিয়ার বহির্ভূত। কাজেই একজন কবির রেলগাড়ির মতো বিরতিহীন ঝমাঝম ছুটে চলা এক সময় ক্লান্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। এঞ্জিনের আয়ু কমিয়ে দেয়। কাব্যে ভারাক্রান্ত হলে কথিত কবিতার মডেলগুলোয় যেসব গেমপ্ল্যান থাকে তার হুঙ্কার শেষ অবধি পাঠকের কানে পৌঁছুতে সময় লাগে। নিদ্রাহীনতায় কবিতা হয়ে ওঠে কোষ্ঠকাঠিন্যে ভরপুর। ফলে একঘরে হওয়ার রিস্ক থেকে যায়। এই গ্রন্থের কবিতাগুলো পড়লাম। মন লাগিয়ে। খুব চড়া তারে তারা যে বাঁধা নয় এটা বুঝলাম। তবে স্থির নয়, প্রবহমান। কবিতার আবহ বোঝাতে দ্বীপ সরকার ব্যবহারযোগ্য শব্দাবলীকে কবিতাসাপেক্ষ কৃত্রিম জটিলতার জালে না চুবিয়ে নিজের কায়দায় সোজাসুজি সাজাতে চেষ্টা করেছেন। কতটা পেরেছেন কাল বলে দেবে সে প্রশ্নের উত্তরলিপি। ছন্দ-টন্দের দিকে মনোযোগ দেননি মোটেই। ছন্দ সংক্ষিপ্ত ভাষণের মধ্য দিয়ে ভাবকে দ্যুতিময় করে তোলে। তার অতিরিক্ত গদ্যময়তা অতিভাষণের রূপ নিয়েছে কখনো কখনো। কবি দ্বীপ সরকারকে বলবো—অতি প্রসব পরিহার করে প্রথমেই তাকে স্থির হতে হবে। অসম্পূর্ণ ধারণা, দিকহীনতা এবং এলোপাথাড়ি হাতড়ে বেড়ানোর টেনশান থেকে মুক্ত হতে হবে। দ্বীপ সরকার একজন নাগরিক কবি, সুতরাং বুদ্ধিশাসিত। নগরজীবনের বিচিত্র জটিলতায় ব্যক্তি হৃদয়ের যে বিচিত্র বিকাশ—তাকে তিনি অভিব্যক্ত করতে পারেন সুন্দরভাবে। আর বুদ্ধির শাসন তার প্রেমের কবিতা পর্যন্তও প্রসূত এবং সবশেষে তার কবিতায় একটা পরিণতির সুর বেজেছে যা অনেকটা স্থির নিশ্চয়তার, প্রগাঢ়, প্রশান্তির।