যার কাছ থেকে কোনো প্রশ্রয়, সুবিধা কিংবা দয়া-করুণা লাভ করা হয়, তার প্রতিই একটা যে দায়িত্ব থেকে যায়, তা যেকোনো বুঝদার লোকই মেনে নিতে বাধ্য। আল্লাহ তায়ালার পর মা-বাবা ছাড়া আর কেউ এমন অত্যধিক দয়া-মায়ায় আমাদেরকে আগলে রাখেন না কখনোই। সীমাহীন কঠোর যাতনার ভেতর দিয়ে মা তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে থাকেন; অতঃপর তারচেয়েও তীব্র ব্যথা-বেদনা সয়ে জন্ম দেন আদরের সন্তানকে। অজস্র নির্ঘুম রাত কাটিয়ে, নিজের শত-সহস্র চাওয়া-পাওয়াকে জলাঞ্জলি দিয়ে সেই সন্তানকে প্রতিপালন করেন সাধ্যের সর্বোচ্চটুকুন উজাড় করে দিয়ে। প্রতিটি সময়ে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিজের চেয়ে সন্তানের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটু একটু করে গড়ে তোলেন বুকের মানিককে। আর বাবা? তিনিই তো আসলে সন্তানের অস্তিত্বের কারণ। আদর-ভালোবাসা আর কঠোর পরিশ্রম ব্যয়ে সন্তানের জন্য সুখ কিনে আনেন রক্তে আর ঘামে। তাই বিবেকবান মাত্রই এমন দয়া-করুণাময় লালনপালনের প্রতিদান যে তার অবশ্য কর্তব্য, তা তিনি নিজেই বুঝতে পারবেন। এমন মহৎ দানের স্বীকৃতি না দেয়া যে কত ঘৃণ্য অপরাধ, তা বলাই বাহুল্য; বিশেষত সন্তান যদি এরপরও মা-বাবার প্রাপ্য অধিকার প্রদান এবং সদাচরণে বিমুখ থাকে, তাহলে নিছক ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ হিসেবেই তা গণ্য হবে। মা-বাবার প্রতি দায়িত্ববান আর সদাচারী সন্তানের একটা কথা কান খুলে শুনে রাখা দরকার। সেটা হলো, যত রকমের উপায়েই সে সচেষ্ট হোক না কেন, কোনো কিছুতেই সে মা-বাবার এই ঋণ শোধ করতে সক্ষম হবে না।
আল্লামা ইবনু কাইয়্যিমিল জাওযীয়া (রহঃ) ছিলেন ইসলামী চিন্তাবিদ, ফকিহ, তাফসীরবিদ, হাদীসজ্ঞ এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের পণ্ডিত। তাঁর পূর্ণ নাম ছিল আবু আব্দুল্লাহ্ শামসুদ্দ্বীন মুহাম্মাদ বিন আবু বকর বিন আইয়্যুব আদ দিমাশকী। তিনি ৬৯১ হিজরী সালে দামেস্কে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর পিতা দীর্ঘ দিন দামেস্কের আল জাওযীয়া মাদ্রাসার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বলেই তাঁর পিতা আবু বকরকে قيم الجوزية কাইয়্যিমুল জাওযীয়াহ অর্থাৎ মাদরাসাতুল জাওযীয়ার তত্ত্বাবধায়ক বলা হয়। পরবর্তীতে তাঁর বংশের লোকেরা এই উপাধীতেই প্রসিদ্ধি লাভ করে। ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমীয়া (রহঃ)-এর স্নেহধন্য শিষ্য ছিলেন এবং শাইখের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি তাঁর সাথেই ছিলেন। এমনকি জিহাদের ময়দান থেকে শুরু করে জেলখানাতেও তিনি তাঁর থেকে আলাদা হননি। তিনি ইসলামী আকীদাহ, তাওহীদ, সুন্নাহ ও বিদআত-বিরোধী বিভিন্ন বিষয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। তার মধ্যে তাওহীদ ও সুন্নাহের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, বিদআতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং ইবাদত-বন্দেগীতে নিষ্ঠা ছিল অন্যতম। ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:
"যাদুল মা‘আদ ফী হাদ্য়ী খাইরিল ইবাদ"
"মাদারিজুস সালিকীন"
"শিফাউল আলীল"
"তিবেব নববী" (চিকিৎসাশাস্ত্রে তাঁর অনন্য অবদান)
তাঁর উস্তাদ বৃন্দ -
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) যে সমস্ত আলেম-উলামার কাছ থেকে তালীম ও তারবীয়াত হাসিল করেন, তাদের মধ্যে রয়েছেনঃ
শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমীয়াহ (রহঃ)।
আহমাদ বিন আব্দুদ্ দায়িম আল-মাকদেসী (রহঃ)।
তাঁর পিতা কাইয়্যিমুল জাওযীয়াহ (রহঃ)।
আহমাদ বিন আব্দুর রহমান আন্ নাবলেসী (রহঃ)।
তাঁর ছাত্রসমূহ -
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রহঃ) এর হাতে যে সমস্ত মনীষী জ্ঞান আহরণে ধন্য হয়েছিলেন, তাদের তালিকা অতি বিশাল। তাদের মধ্যে রয়েছেনঃ
বুরহান উদ্দ্বীন ইবরাহীম বিন ইবনুল কাইয়্যিম।
ইমাম ইবনে রজব (রহঃ)।
হাফিয ইমাম ইবনে কাছীর (রহঃ)।
তিনি একজন নিরলস সাধক, যিনি দীর্ঘ সময় ইবাদত করতেন, বিশেষ করে তাহাজ্জুদ ও কুরআন তিলাওয়াতে মগ্ন থাকতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ইলমী ও আধ্যাত্মিক খেদমত মুসলিম উম্মাহর জন্য অমূল্য দান হয়ে রয়েছে। ইবনুল কাইয়্যিম ৭৫১ হিজরী সনে মারা যান এবং দামেস্কের বাবে সাগীর গোরস্থানে তাঁর পিতার পাশে দাফন করা হয়।