নাজিয়া দরজায় দাঁড়িয়ে ঘরটার দিকে ভালো করে চোখ বুলালো। মা নিজের হাতে ঘরটা তার জন্য যত্ন করে সাজিয়েছিলেন। আজ এই ঘর ছেড়ে তাকে চলে যেতে হচ্ছে সম্পূর্ণ অচেনা বাড়িতে। ওখানের ঘরে কি তার এমন করে মন বসবে? এই ঘর ছেড়ে নতুন বাড়িতে সে কী করে থাকবে? বাবা আবার ডাকলেন, -নায়া মামণি এসো। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। নাজিয়া চোখ মুছলো। পা সরছে না তার। নিজের ঘর ছেড়ে যাওয়া এত কষ্টের কেন? বাবা পেছনে এসে দাঁড়ালেন। নাজিয়া ভেজা চোখে বললো, -বাড়ির জন্য খারাপ লাগছে পাপা। আমরা কি আর কখনোই এ বাড়িতে ফিরে আসবো না? বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, -এমনও তো হতে পারে নতুন বাড়িটা আরো ভালো লাগলো তোমার, আর ফিরে আসতেই ইচ্ছে করলো না এ বাড়িতে। হয়তোবা ওই বাড়িটা এই বাড়ির থেকেও আপন হয়ে গেল তোমার কাছে। নাজিয়া রোবটের মতো পা ফেলে ফেলে এসে বাবার সাথে গাড়িতে বসলো। মা চলে যাবার পর যেন সব আনন্দ, সব ভালোলাগা এক এক করে হারিয়ে যাচ্ছে তার জীবন থেকে। প্রতি মুহূর্তেই ভালোবাসার শূণ্যতা তৈরি হচ্ছে মনের ভেতর। আর কোনোদিনও কি নাজিয়ার জীবনে হাসি আনন্দ ফিরে আসবে? যদি না আসে নাজিয়া কী করে বেঁচে থাকবে? বাবার বুকে মাথা রেখে নাজিয়া ফুঁপিয়ে উঠলো। -মা কেন আমাদের ছেড়ে গেল পাপা? কেন? আমরা এত কষ্ট নিয়ে বাকী জীবন কী করে বাঁচবো বলো তো? বাবা জবাব না দিয়ে নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নতুন বাড়িতে পা রাখতেই নাজিয়ার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বাড়ির সামনে প্রেসের গাড়ি। নাজিয়াকে দেখে দু'জন সাংবাদিক ছুটে এলেন। -হ্যালো ম্যাম। আমরা আসলে সিঙ্গার আহনাফের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে একটা রিপোর্ট তৈরি করছি। আপনি যদি আমাদের কিছু তথ্য দিয়ে সাহায্য করতেন। উনার ব্যক্তিগত জীবনটা আসলে কীরকম? নাজিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ো গেল। এই সিঙ্গার আহনাফটা আবার কে? -শিল্পী আহনাফ ব্যক্তিগত জীবনে কেমন মানুষ? দেখুন উনাকে ঘিরে কিছু রিউমার আছে শোবিজ ওয়ার্ল্ডে এগুলো কি আসলেই ঘটেছে? নাজিয়া আমতা আমতা করে বললো। -আমি তো উনাকে চিনি না। -ম্যাম প্লিজ, আমাদের এড়িয়ে যাবেন না। আমরা আসলে খুব ছোট কিছু তথ্য জানতে চাইবো। আপনার নাম আমরা গোপন রাখবো। উনার ফ্যানবেজটা কিন্তু আপনাদের মতোই ইয়াংদের। আপনাদের তথ্য থেকেই কিন্তু একচুয়েল রিফ্লেক্টিভ জার্নালটা আমরা লিখতে পারবো। -দেখুন, আমি সত্যি বলছি, আমি এই বাড়িতে আজ প্রথম এসেছি। উনি কে আমি আসলেই জানি না। প্লিজ! সাংবাদিক দুজন নাজিয়ার কথা বিশ্বাস করলো বলে মনে হলো না। একটার পর একটা প্রশ্ন করতেই থাকলো। নাজিয়া দ্রুত পায়ে গেটের ভেতরে ঢুকে গেল। বুয়া বিরক্ত স্বরে বললেন, -কী যন্ত্রণায় পড়লেন কন তো আপামণি! উনারা তো এমনভাবে আপনারে জিগাইতেছে, যেন আপনে ওই শিল্পীর পরিবার। যুগ যুগ ধইরা সংসার করতেছেন শিল্পীর সাথে। নাজিয়া বিরক্ত স্বরে বললো, -আপনি যে কী সব অজগুবি কথা বলেন না বুয়া। উফ! -বলবো না? বাড়িতে পা ফেলার আগেই সাম্বাদিকের দৌড়ানি। বাড়ির ভিতরে গেলে না জানি কী ঘটে? হুহ! নাজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এই বাড়িতে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে? আনন্দ না দুঃখ?
এই একটা ব্যাপার লিখতে এলেই আমার মাথার ভেতর ফাঁকা হয়ে যায়। ব্যক্তিগত তথ্যগুলো কেন জানি মানুষকে জানাতে ইচ্ছে করে না। আরেকটু গুছিয়ে বললে, বলার সাহস পাই না। তবে আজ ঠিক করেছি নিজের কিছু কথা বলবোই। আচ্ছা, লিখা ভালো লাগার জন্য কি লেখকের পরিচয়টা আদৌ জরুরি? আমার মনে হয় না। নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি, এমন অসংখ্য লিখা আমার ভালো লাগার আছে, যাদের লেখককে আমি দেখিনি। হয়তোবা লেখকের ছবি বইয়ের পেছনে ছিলও। কিন্তু আমি দেখিনি। কারণ লিখার মাধুর্য আর গল্পের চরিত্র আমায় টেনেছে, লেখক নয় । ফেলুদা যখন পড়ি, আমি ভেবেছি ওটা তোপসেরই লিখা অন্য কারো নয়। সত্যজিৎ রায়ের পরিচিতির জন্য আমি কিন্তু একটুও ব্যাকুল হইনি। শার্লক হোমস যখন পড়ি, আমি স্যার আর্থার কোনান ডয়েলকে একদিনও চিনতে চাইনি। বরং বারবার আমার কল্পনায় শার্লক হোমস সামনে এসেছে। বারবার আমি লিখা আর গল্পের চরিত্রতে মুগ্ধ হয়েছি। একজন লেখকের জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া কি জানেন? তাঁর লিখার জন্য পাঠকের ভালোবাসা। সুতরাং তৃধা আনিকার ব্যক্তিগত জীবন আপাতত লুকানোই থাক। তার চেয়ে বরং তৃধা আনিকা তার গল্পে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র সেজে নিজের মনের কথাগুলো অনায়াসে বলে যাক । দেখা যাক না, কি হয়। পাঠক তার লিখাকে কেমন ভালোবাসে, দেখি!