"চেনা নগরী অচেনা বাসিন্দা" বইটির ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিকদের মধ্যে যারা বাংলাসাহিত্যে ভোরের শুকতারার মতো জ্বলজ্বলে এবং ছোটগল্প নির্মাণে ইতোমধ্যে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন তাদের মধ্যে রহমান মিজানুর অন্যতম। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় এই কীর্তিমান লেখকের স্বাচ্ছন্দ্যে পদচারণা রয়েছে। মেধাবী গল্পকার রহমান মিজানুর যেমন বিজ্ঞান প্রযুক্তি নির্ভর গল্পের মধ্যে প্রাণস্পন্দন সৃষ্টি করে পাঠককে চমকে দিতে পারেন। তেমনি পারেন অত্যন্ত রূঢ় কোন চরিত্রের গহীনে লুকায়িত কোমল মানবিক রূপটি বের করে এনে মনোজ্ঞ উপস্থাপনের মাধ্যমে পাঠকের মন রাঙিয়ে দিতে। তার গল্প বলার ভঙ্গি, বর্ণনার চমৎকারিত্ব, বিষয় নির্বাচনের দক্ষতা, সুচারু ধারাবাহিকতা, পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখার কৌশল, সর্বোপরি কলমের সম্মোহনীশক্তি তাকে এক অনন্য মৌলিকত্ব দিয়েছে। যা অন্য কোনো গল্পকারের বর্ণনার স্টাইলের সাথে মিলে না বললেই চলে। তাঁর বর্ণনার ধরণ ছোটগল্পের প্রবাদপুরুষ প্রখ্যাত আন্তন চেখবের বর্ণনার ধরণের কিছুটা কাছাকাছি এসে যায়। তবে সেখানেও কেউ কারো মৌলিকতার সীমারেখা অতিক্রম করে না। লেখকের এই সংকলনে মোট আটটি গল্প স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে তিনটি গল্পের কাঠামো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে ভিত্তি করে রচিত। এগুলোকে বিজ্ঞানকল্প বলা যেতে পারে। অপর পাঁচটি গল্প সমসাময়িক নাগরিক জীবনের হৃদয়িক অনুভূতি, সামাজিক অসামঞ্জস্যতা, মানবিক রহস্যময়তাকে উপজীব্য করে ঘটনা প্রবাহ দিয়ে সাজানো। প্রতিটি গল্পই আনকোরা বিষয় এবং কৌতুহল উদ্দীপক চমৎকারিত্বে ঠাসা। ঘটনা বর্ণনায় ভাষার প্রয়োগ এতোটাই সাবলীল যে, অতি অস্বাভাবিক ঘটনাকেও পাঠকের কাছে একসময় মনে হবে, এরকম হওয়াই তো স্বাভাবিক! যেমন 'কাজলরানি ও তার পুত্র' গল্পটিতে আমাদের পারিপার্শ্বিক নিত্য ঘটতে থাকা কিছু ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে লেখকের নান্দনিক বর্ণনার ছোঁয়ায়, একেবারেই উল্লেখযোগ্য নয় এমন সাদামাটা চরিত্রগুলোও মানবিকতার রঙ লেগে হয়ে উঠেছে অসাধারণ এবং প্রাণস্পর্শী। আবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক কল্পকাহিনী নিয়ে তিনটি গল্প আছে। গোলাম, ফেসবুক ফ্রেন্ড এবং দ্বিতীয় জগৎ। গোলাম গল্পটি লেখকের উর্বর মস্তিস্কের চিন্তা প্রসূত একটি কল্পকাহিনি। এখানে আসলে গল্পের আদলে এক ভয়াবহ অবক্ষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে, এবং তার দিকে তর্জনী নির্দেশ করে সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। দেখানো হয়েছে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কিভাবে অতিদ্রুত সর্বনাশা ভার্চুয়াল জগতের টানে আসক্ত হয়ে ভুলতে বসেছে নিজেদের মানবীয় সত্ত্বাকে। গল্পে উল্লেখিত স্থান ও সময়ে ভার্চুয়াল মানবীর উপস্থিতি এবং পরবর্তী ঘটনাসমূহ.... পড়তে যেয়ে পাঠক একইসাথে রোমাঞ্চিত এবং শিহরিত হবেন। এভাবে প্রতিটি গল্পে পাঠকের জন্য রয়েছে একরাশ বিস্ময় আর চিন্তার খোরাক। এদিক দিয়ে রহমান মিজানুর এক অসাধারণ গল্পকার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। গল্পকার রহমান মিজানুর-এর লেখাই বলে দেয়, ভিন্ন এক দৃষ্টিকোন থেকে সমাজকে দেখে লিখতে লিখতে তিনি সাহিত্যের পথে অনেক দূর এগিয়ে যাবেন। অনেকটা চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিতে নিজেকে তিনি গুছিয়ে নিচ্ছেন। তার অন্য উপন্যাসের মতো এই গল্পগ্রন্থটিও ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পাবে আমার বিশ্বাস। লেখকের কলম দীর্ঘজীবী হোক, শুভ কামনা। মাহবুব খান কবি ও ঔপন্যাসিক প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব, অনুশীলন সাহিত্য পরিষদ।