উপন্যাসের পরিবেশ নির্মাণকৌশল চরিত্রের যাপিত জীবনের ঘটনা কার্যকারণসূত্রে অন্বিত হলে তাকে আখ্যান বলা হয়। এই আখ্যানের সঙ্গে চরিত্রের যে যোগ তা কালগত-স্থানগতভাবে অনিবার্যতায় জারিত হয়। জীবনের কল্পিত আখ্যানকে বাস্তবানুগ ও বিশ্বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে ঔপন্যাসিককে চরিত্রের ও কাহিনির মানানসই পরিবেশ নির্মাণ করেন। এই পরিবেশ নির্মাণ বা বর্ণনা বলতে প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক দৃশ্যের বর্ণনা নয়-উপন্যাসের কাহিনিকে পাঠকের বিশ্বাসযোগ্য ও বাস্তবতার নিরিখে নির্মাণ করতে চরিত্রের জীবনাভিজ্ঞতার সমান্তরালে দেশ-কাল- সমাজকে অঙ্কন করার নিগূঢ় পদ্ধতি। আখ্যান ও চরিত্রের সঙ্গে দেশ-কাল-সমাজের মেলবন্ধনটি সুদৃঢ় করতে পরিবেশ নির্মাণকৌশল অতীব গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা দেয উপন্যাসের প্রকরণকৌশলে। উপন্যাসের কোনো কাহিনিই চরিত্র ও সময়-সমাজ-বহির্ভূত নয়। উপন্যাসের পটভূমি প্রাকৃতিক-ভৌগোলিক-সামাজিক ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে। সময় ও সমাজের সঙ্গে আখ্যানবস্তুর ভিত্তিভূমির সুবিন্যস্তকরণ পদ্ধতি উপন্যাসের পরিবেশ-কল্পনা বা সংস্থানপদ্ধতি (Setting)। পরিবেশ চরিত্রকে যেমন আন্দোলিত করে, তেমনি আখ্যানে পরিপুষ্টতা দান করে।
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।