চরম উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্যে সেবাপরায়ণা বিনোদিনী এবার তার হিংসা চরিতার্থ করতে ছলনার আশ্রয় নিয়েছে। গৃহিণী রাজলক্ষ্মী আগেই তার সেবায় বশীভূত; এবার বধূ আশালতার অন্তর জয় করে তার সর্বনাশ প্রক্রিয়া। বিনোদিনীর রূপ-গুণ এবং যৌবনের খরউত্তাপের পাশে শান্ত-স্নিগ্ধ আশা হতবাক হয়ে পড়েছে। শিল্পী যেন অপ্রত্যক্ষভাবে তারই বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, "বিনোদিনী যখন তাহার জোড়া ভুরু ও তীক্ষ্ম দৃষ্টি, তাহার নিখুঁত মুখ ও নিটোল যৌবন লইয়া উপস্থিত হইল, তখন আশা অগ্রসর হইয়া তাহার পরিচয় লইতে সাহস করিল না।" কিন্তু বিনোদিনীর ব্যাক্তিত্ব অনেক সক্রিয়, যাদুকরের মতো সে এগিয়ে এসে পরিস্থিতি পালটে দিল। তাকে এগিয়ে আসতে দেখে আশা কহিল, এস ভাই, তোমার সঙ্গে একটা কিছু পাতাই।" বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, 'কী পাতাইবে?' আশা কহিল, 'তোমার কোনটা পছন্দ?' -বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, 'চোখের বালি।' আশা আনন্দের সঙ্গে বিনোদিনীর এই আদরের নামটি গ্রহণ করল এবং চোখের বালি-র গলা ধরে হেসে লুটিয়ে পড়ল। এখানে মায়াবিনী বিনোদিনীর বিজয়নাট্যের প্রথম অধ্যয় সমাপ্ত। স্মরণীয় যে রাজলক্ষ্মীর ধারণা তার শান্ত-সুবোধ মহিনকে ঐ নতুন বৌটা নষ্ট করতে চলেছে। তাকে শিক্ষা দিতে সর্বগুণান্বিতা বিনোদিনীকে তিনি সঙ্গে এনেছেন, উদ্দেশ্য আশালতাকে এক প্রস্ত শায়েস্তা করা। তার ফলাফল তিনি জানতে পেরেছেন পরে, সর্বনাশ সমুৎপন্ন হবার পর। মায়ের প্রতিহিংসা বিনোদিনীর প্রতিহিংসার পথকে সুগম করেছে বহুলাংশে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।