জীবন মােহময় মধুময়। কিন্তু তার পরতে পরতে ছড়ানাে বিষের বালি। মানুষের পা যেখানে পড়ে, সেখানে সভ্যতা জাগে। আবার সেই পায়ের নিচেই ঘাস মরে যায়, হলদে পাশুটে বর্ণ হয়ে যায় । নগরক্লান্ত আজকের সভ্য মানুষের গােড়াপত্তন সেই কবে গ্রাম ও গঞ্জসভ্যতার ভেতর দিয়ে হয়েছিল। সে কথা মানবেতিহাসে অনুমানে ধৃত হয়ে আছে। কিন্তু যিনি এই অনাগরিক অবিক্ষত সভ্যতায় বেড়ে উঠেছেন তার কাছে তা এক বড় অভিজ্ঞতা। স্বদেশ-স্বসমাজকে সেই শিল্পীই প্রকৃতভাবে ধরতে পারেন জীবন যার কাছে অবচয় হয়ে ধরা দেয়নি। রায়পুরের উপকথা সেই বিক্ষত-অবিক্ষত জীবনের গল্প । স্বয়ং লেখক যেখানে অংশীদার সেখানে জীবন খুচরা-বাণ্ডিলে পরিণত হয় না। সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারি ব্যবস্থার ব্যবচ্ছেদে ভূমিবিন্যাসের নতুন রূপ সৃষ্টি। তারপর থেকে পাল্টে গেল গ্রামজীবন। লাঙল যার জমি তার’- এই পরম বাণী কৃষকজীবনের দর্শনজগতে নাড়া দেয়। কিন্তু কালে ক্ষমতা-কাঠামাের এক চোরাবালির প্রবল। টানেও অপরিবর্তিত থাকে মানুষের জীবন। জমিদার মতু বাবুর জৌলুস ফুরিয়ে যাওয়ার দগদগে দিনগুলাে উপন্যাসে অঙ্কিত। সর্বোপরি ব্রিটিশ উপনিবেশপরবর্তীকালের বিচিত্র কর্ম-পেশার গ্রামীণ মানুষ, স্বভাবজাত শিল্পী ও নিচুবর্ণের অসংখ্য মানুষের গভীর কোলাহলে সিক্ত এই আখ্যান। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সীমাহীন রেখায় সমান্তরাল বয়ে যায় মানবিক অন্তস্রোত। সেই স্রোতে ভিড় করে কত কথকতা, বিচিত্র জীবন, বিচিত্র কালের খেয়াল । বাইদ্যা-বাইদ্যানী থেকে দরবেশ-পীর-ফকির , কবিগান থেকে বেনেগান, লােকসংস্কৃতি কি প্রাণ-প্রকৃতি সেখানে সহজিয়া কড়চা প্রস্তুত করে। আখ্যানের। প্রত্যেকটি শিল্পিত শিরােনামউপশিরােনামে অঙ্কিত হয় জীবনের ইঙ্গিতবহতা, সুগভীর তাৎপর্যময়তা। কিংবদন্তী-রূপকথা ও লােক-ঐহিত্যের পথ বেয়ে লেখক-অভিজ্ঞান বাংলা সাহিত্যের সৌন্দর্যময় সাহিত্যপ্রকরণ-বিভায় আলােকিত হয়। মানব-চৈতন্যের কোনাে রঙ আছে। কীনা জানা নেই। তবে রায়পুরের উপকথা’ নিরেট বাস্তব এক মৃদু-প্রখর জীবনের ছায়ায় শ্যামল বাংলার সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি।