”পথের পাঁচালী” বইটির সম্পর্কে কিছু কথাঃ ‘পথের পাঁচালি' উপন্যাসে চরিত্র চিত্রনে, উপাখ্যান রচনায়, বাচনভঙ্গিতে এবং ভাষার শিল্প সৌকর্যে বিভূতিবাবু যে অবিশ্বাস্য পারদিৰ্শতা দেখিয়েছেন তা সত্যিই বিরল। উপন্যাসে প্রধান এবং অপ্রধান উভয়বিধ চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটানাে হয়েছে। প্রধান চরিত্রের মধ্যে রয়েছে হরিহর, সর্বজয়া, অপু, দুর্গা প্রভৃতি এবং অপ্রধান চরিত্রের মধ্যে আছে ইন্দির ঠাকুরুন, সেজ বৌ, সখী ঠাকুরুন, অজয়, গােমস্তা প্রভৃতি। উপন্যাসের নামকরণে বিষয় নিয়ে তেমন কোন বিতর্ক না থাকলেও পাঁচালি অর্থে বিভুতিভূষণ বাবু সম্ভবত জীবন ও পরিবেশের কথকতা পরিবেশন করেছেন অত্যন্ত দক্ষতা ও নিপূণতার সাথে। উপন্যাসকে তিনি মূল তিনটি উপ-শিরােনামে বিভক্ত করেন- বল্লালী বালাই, আম আঁটির ভেঁপু এবং অত্রুর সংবাদ । প্রথম অংশে পথে পথে ঘুরে বেড়ানাে কাহিনী বর্ণনা করা হয়। এভাবে কোথাও নির্দিষ্ট ঠাই না পেয়ে পথেই ফাইনাল ঘুম দেওয়ার চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে। এ অংশে রাজা বল্লাল সেনের আমলের কলিন্য প্রথাকে বিদ্রোপাত্মক কথায় বল্লালী বালাই’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাল্য বিবাহ, বিধবা বিবাহ, বহুবিবাহ ইত্যাদি বিষয়ে কলিন্যের যাতাকলে পিষ্টদের জীবনের আকুতি বিভিন্ন সুরে প্রকাশ পেয়েছে। দ্বিতীয় অংশে নিজের বাল্য জীবনের শিশু-কিশাের বয়সের অনেক কাহিনী বিবৃত হয়েছে। সাধারণত কিশাের বয়সে আমের আঁটি দিয়ে ভেঁপু বাজানাের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অত্রুর সংবাদে দেখা যায় অত্রু ছিলেন কৃষ্ণের পিতৃব্য। কংস কৃষ্ণ ও বলরামকে ধ্বংস করার জন্য অত্রুকে পাঠান তাদের ধুনযজ্ঞে ডেকে আনার জন্য। অঞ কংসের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেন। ফলে কৃষ্ণ কংসকে হত্যা করেন। অত্রুকে পাঠানাে হিতে বিপরীত হল। পথের পাঁচালিতে বিভিন্ন মাত্রায় ও রসে পাত্রপাত্রীদের জীবনের পথ হাঁটার প্রেক্ষিতে তাদের চারপাশের মানুষের জীবনের পাচালী বা কথকতা উপস্থাপিত হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।