কোন প্রকার ভণিতা না দিয়েই বলা যায় যে আমাদের লোকসংগীত ও লোকসংস্কৃতির মধ্যেই লালিত ও প্রকাশিত হয়েছে আমাদের হাজার বছরের লোকচেতনা এবং নিজস্ব দর্শন। সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক পথচলায় এর গতি-প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়েছে অসংখ্যবার। আর আমাদের প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যই এটা। এখানকার প্রকৃতিই নির্ধারণ করে দেয় এখানকার মানুষের সংস্কৃতি কেমন হবে। এমন উর্বর ভূমির গঠন সারাবিশ্বে সত্যিকার অর্থেই বিরল। এখানে বৃক্ষ থেকে ফল পরিপক্ক হয়ে মাটিতে পড়ে তা থেকে আপনা হতেই আবার নতুন বৃক্ষের জন্ম হয়। ষড়ঋতুর এমন বৈচিত্র্যময়রূপ পৃথিবীর খুব কম স্থানেই দেখতে পাওয়া যায়। হিমালয় ও বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী এই স্থানটি উর্বর ও শস্য ফলনের জন্য অতি উপযোগী বলে সারাবিশ্বে প্রাচীনকাল থেকেই এর পরিচিত রয়েছে। এ-ভূমি যেন প্রকৃতির একান্ত আর্শীবাদে গড়া। হাজার বছর ধরে প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত উপকরণে এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা পরিচালিত হয়েছে এবং এখানকার লোককবিগণ মানুষের কল্যাণের জন্য নব-নব মত ও পথের সন্ধান দিয়েছেন, যুগিয়েছেন আত্মার খোরাক। সে পথে গ্রামীণ জীবনে বসবাসকারী সাধারণ মানুষের সাধনার পথ নির্ধারিত হয়েছে। সাংখ্য, তন্ত্র, যোগ সাধনার মাধ্যমে যুগে যুগে মানুষ বিকশিত এবং সমৃদ্ধ করেছে এখানকার কল্যাণমুখী ভাবনাকে। বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব সাধনার বিষয়টি আমাদের কাছে খুব বেশি প্রাচীনকালের না হলেও এখানকার মানুষের দর্শন চর্চার ইতিহাস বেশ পুরনো। সমগ্র বিশ্বে মানবতাবাদী চেতনার যে চর্চা আজকের দিনে হতে দেখা যায় তার উদ্ভব এ ভূমিতেই। বলাযায় আমাদের পূর্ব-পুরুষেরাই সমগ্র বিশ্বকে শিখিয়েছেন কিভাবে মানবিক পৃথিবী গড়া সম্ভব। মানুষের কল্যাণ ও ভাবনালোকের মুক্তিকল্পে ‘বৈষ্ণব দর্শন’ এখানকার সমগ্র জনগোষ্ঠীর কাছে একটি জনপ্রিয়ধারা, যার বিকাশ ও প্রকাশ ঘটেছে সংগীত ও সুরের মাধ্যমে। বর্তমান গ্রন্থে আমাদের অতি পরিচিত ও প্রিয় এ-ধারার নানা বিষয়াদি নিয়ে বিস্তর আলোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বৈষ্ণবকবি রাধারমণ সৃষ্ঠ সাধনগীতের রূপ, বৈশিষ্ট্য, দর্শন, বিষয়বস্তু, গঠন, পরিবেশনরীতি, চর্চার গতি-প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয়ে পাঠের মাধ্যমেপাঠকগণ জীবনের আনন্দে নিমজ্জিত হোক এই আশা ও কামনা করছি।