তাঁর লেখার নায়ক-নায়িকারা সকলেই খুব চেনা। যেন তাদের সঙ্গে পাঠকের একবার না একবার ঠিক দেখা হয়েছিল। তাদেরই কেউ হয়তো পাঠককে হলুদ মাখানো ইলিশ কিংবা অনেক বছর ধরে চরায় আটকা পড়ে থাকা কোনো পুরনো নৌকার গল্প শুনিয়েছিল। কুলদা রায় এভাবেই গল্প লেখেন। তাঁর চরিত্ররা কাহিনির ভেতর প্রবেশ করে স্বতন্ত্র গল্পের ডালি খুলে বসেন। অভিনব এক মরমি ভাষায় গল্প বলতে পারেন কুলদা, যা কেবলমাত্র তাঁর সুমিষ্ট কথনের গুণে ক্রূর থেকে ক্রূরতর বাস্তব, ঘৃণা আর লালসার জগতটাকেও করে তোলে মোহময়ী এবং মরমী। কুলদার চরিত্ররা কেউই অন্ধকারের বাসিন্দা নন। ক্ষোভ, অভিমান, মনে মনে তারা ধারণ করলেও কেউ উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করেন না, কোনো হিংসাশ্রয়ী কি ধ্বংসাত্মক পথ নিজের জন্য বেছে নেন না। ক্ষমতাবান ও উঁচুতলার মানুষ কুলদার কাহিনির পার্শ্বচরিত্র। কেন্দ্রে বিরাজ করেন একাকী সব মানুষ, বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের খোঁজে তাদের কেউ হয়তো সমাজবিচ্ছিন্ন, বা দেশত্যাগী। এত বিচিত্র সব চরিত্র ও তাদের চমকপ্রদ গল্পের মধ্যে যে চরিত্রটি সবচাইতে উজ্জ্বল, সেটি হল গ্রামবাংলা, বাংলাদেশ। কুলদা রায়ের কথনশৈলীতে বাংলাদেশ তাঁর নিরবচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মরমিমনের মানুষে ভরা প্রাচীন জনপদ, সেখানকার ইতিহাস, লোকগাথা, ঘুমপাড়ানি গান, বিশ্বাস এবং সংস্কার, লোকাচার, অজস্র আঞ্চলিক ভাষা, দেশভাগ, জাতির নতুন গঠন, মুক্তিযুদ্ধ, সব কিছু নিয়ে বর্তমান সময় থেকে সুদূর অতীত হয়ে নিজেকেই নিজে বারবার অবলোকন করে চলেছে কোনো এক জাদু-আয়নায়। তাই কুলদা রায়ের কথনে সময় কখনো রোমান্টিক, কখনো বা অস্থির কোনো দুঃসময়। তাঁর কথন অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ হেলায় অতিক্রম করে যায়, এমন কি আন্তর্জাতিক সীমানা, কাঁটাতারও। জাদুকরী এক বাস্তবের আদলে লেখা চমকে দেওয়া ‘যে সুচিত্রা সেনকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল’ গল্পের শিরোনামের এই নতুন গল্প-সংকলনে রয়েছে এই গল্পটি সমেত মোট আটটি গল্প। -সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত