আমার শৈশবটা ছিল অন্য রকম। আমার ছেলেবেলাটা আমার চার পাশের অন্য আর দশজনের মতো করে কাটেনি। সাধারণের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন তো বটেই ! অন্য রকম শৈশব। এ গ্রন্থে চিত্রিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালে এবং তার পরবর্তী দুই বছর (১৯৭১ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল) মোট তিন বছরের পাকিস্তানে বন্দি শৈশবকাল। আমার এই লেখনীর ক্ষুদ্র প্রয়াস, যুদ্ধবন্দিকালীন সেই ভিন্নতর এক শৈশবকে নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) পাকিস্তানিদের অত্যাচারের ইতিহাস সকলেরই জানা, কিন্তু তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের হাতে বন্দি থাকা বাঙালিদের, দুর্ভোগের ইতিহাস অনেকেরই তেমন জানা নেই! সে বিষয়ের কিছুটা চিত্র, আমার সেই বয়সের চোখে দেখা এবং তখন যাঁরা পাকিস্তানে আমাদের সঙ্গে বন্দি ছিলেন, তাঁদের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সে সব ঘটনা, এ লেখায় সর্বসমুখে আনার ব্যাপারে সচেষ্ট হয়েছি। ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন আমার বয়স সাত বছর। আমি আমার বাবা মরহুম ফ্লাইট সার্জেন্ট (অব.) আলহাজ্ব মিসবাহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে পরিবার সহ, তাঁর তৎকালীন কর্মস্থল সৌদি আরবে বসবাসরত ছিলাম। তিনি তখন পাকিস্তান এয়ারফোর্সে কর্মরত ছিলেন। সেই চাকরি থেকেই তাকে সরকারি ভাবেই পাকিস্তান সরকার কর্তৃক করাচি থেকে সৌদি আরবের ‘খামিস মোর্শেদে’ পাঠানো হয় ১৯৬৭ বা ’৭৮ সালে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক পাকিস্তানের বাইরে পাঠানো যে সকল বাঙালি এয়ারম্যান পাকিস্তানের বাইরে কর্মরত ছিলেন, সেই সকল বাঙালি এয়ারম্যান এবং তাদের পরিবারকে পাকিস্তানে ফিরে আসার নির্দেশ প্রদান করে। পাকিস্তানের বাইরে এয়ারফোর্সে কর্মরত সকল বাঙালির মতো আমার বাবাকেও আমাদের সহ সরকারি নির্দেশে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে এসে বন্দিত্ব বরণ করতে হয়। আমি খুব ছোট ছিলাম। সন, তারিখ বা ঘটনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ বলতে পারবো না। তবে ঘটনাগুলো যা এখনো আমার স্মৃতিপটে তাজা আছে সেগুলোই বলার চেষ্টা করেছি এবং সেই সাথে দুইজন এয়ারম্যান কাকা যাঁরা আমাদের সঙ্গে সেখানে বন্দি ছিলেন এবং আপু ভাইয়ারা যাঁরা সেই সময় আমাদের সঙ্গে পাকিস্তানের সেই ক্যাম্পে অবস্থান করেছিলেন, আমি বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের জন্য তাঁদের সাহায্য নিয়েছি। কাকাদের একজন ফ্লাইট সার্জেন্ট মো. জসীমউদ্দিন কাকা এবং অন্যজন সার্জেন্ট আবদুল আজিজ কাকা। এ ছাড়াও আমার বড় ভাই শামসুল আলম শাহিন, কৃষিবিদ মোসারফ ভাই এবং আরও আপু ভাইয়ারা আছেন, যাদের নিকট হতে বিভিন্ন তথ্যাদি সংগ্রহ করে, পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি থাকা অবস্থার ঘটনাগুলো উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। লেখাটির খসড়া আমি ২০১০ সালে শুরু করি, পরবর্তীতে এ লেখাটি গুছিয়ে আমার ফেইসবুক পেইজে প্রকাশ করি আগস্ট, ২০১৯ সালে ধারাবাহিক ভাবে এবং পেন্সিল গ্রুপেও তখন এটি প্রকাশিত হয়। এছাড়া ১২/১২/১৯ সালে “সমকাল” অনলাইন পত্রিকায় পাঁচ পর্বে এটি প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালে ‘পশ্চিম-পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধ পরবর্তী বন্দি বাঙালি’ সংক্রান্ত আমার একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয় বি বি সি বাংলা ‘প্রভাতী’ অনুষ্ঠান থেকে। যা এই লেখাটি এগিয়ে নিতে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করেছে আমাকে। অতঃপর লেখাটির প্রতি পাঠক সমাজের বেশ আগ্রহ লক্ষ্য করি এবং এটি বই আকারে প্রকাশ করার অনুরোধ ও পরামর্শ আসতে থাকে। অবশেষে সেইটিই ইতোপূর্বে অলিখিত ঘটনা সন্নিবেশিত করে এবং তথ্য আরো বিস্তারিত লিখে, গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করার মনস্থির করি। ভুল-ত্রুটি মার্জনীয়। সুরাইয়া পারভীন।