অনিন্দিতা নামের একটি মেয়ে জেনে গেছে ওর বাবার ফুসফুসের চুরানব্বই ভাগ জায়গা করোনা গ্রাস করেছে। ডাক্তাররা বলে গেছে রোগীর বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা দশ ভাগেরও কম। কিন্তু মেয়েটি আশা ছাড়ে না। ওই দশ ভাগ চান্সকে আতশকাচের মাঝ দিয়ে তাকিয়ে অনেক বড় করে দেখতে থাকে মেয়েটি। ওর কাছে শতকরা দশ ভাগ কোনো নিছক সংখ্যা নয়, ওর বাবার ভালো হয়ে ওঠার সুস্পষ্ট ইশারা। অনির চারপাশের পৃথিবীতে প্রতিদিন কী ঘটছে তা ও জানে না, জানতেও চায় না। এদিকে বিশ্বময় ক্রমেই ক্ষুধাতুর হয়ে উঠছে করোনা নামের এই সর্বনাশা ভাইরাস। জল-স্থল আর অন্তরীক্ষ সবকিছু দখল করে নিয়েছে করোনা নামের এক অদৃশ্য শত্রু। ডাক্তারদের কাছে কোনো বিহিত নেই, ওষুধ নেই। রোগের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলে যথার্থ কোনো উত্তর নেই। অক্ষমতার সংকোচে একজন মানুষের চোখ-মুখ যেমন দেখা যাওয়া উচিত ঠিক তেমনি দেখতে প্রতিটি ডাক্তারের মুখাবয়ব। বিশ্বব্যাপী অনড় অটল হয়ে এতদিন দাঁড়িয়ে থাকা বিজ্ঞানের জয়স্তম্ভের উৎসে দেখা দিয়েছে এক ভয়াবহ ফাটল। শতাব্দীর অহংকারের দর্প চূর্ণ হয়েছে। মানবসভ্যতা যেন এই অণু দানবের সামনে একেবারে হাঁটু গেড়ে নুয়ে পড়েছে। এক ঘোর অশ্লেষা আর ত্র্যহস্পর্শের ছোঁয়া লেগেছে যেন অনিদের চারজনের সংসারে। বাবা-মা দুজন একসাথে হাসপাতালে, একই অসুখে। বাবা কি বাঁচবে, এ কথাটা যেন শক্তিশেলের মতো বিঁধে আছে মেয়েটির তাবৎ সত্তায়। বাবা কেমন আছে তা ডাক্তারদের কাছে জিজ্ঞাসা করলে তারা মহাকালের মতো নিরুত্তর নিরুচ্চার হয়ে যায়। এই শব্দহীনতার অর্থ অনি বোঝে। কিন্তু তা ও মানতে পারে না। বাড়ির কারুর জ¦র হলে চিরচেনা মানুষটিও তার আশপাশে থাকতে চায় না। মানুষটি আপন কিন্তু অসুখটি তো আর আপন না। স্বামী চলে যায় স্ত্রীকে ছেড়ে, স্ত্রী স্বামীকে, ভাই আসে না বোনকে একনজর দেখতে, পরম আত্মীয়ও একবার হাসপাতালে রোগীর খবর নিতে আসে না। কিন্তু সব সমীকরণ ব্যর্থ করে দিয়ে বারো নম্বর বেডের রোগীর মেডিক্যাল কলেজে শেষ বর্ষে পড়–য়া মেয়ে অটল অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাবার পাশে অষ্টপ্রহর। হাইফ্লোর তরঙ্গায়িত বাতাসে এই অণুদানব ঘুরে ফেরে সহজ শিকারের লোভে। চকিত বেখেয়াল হলেই আর উপায় নেই। সর্বনাশ এসে বাসা বাঁধবে অনির নিজের বুকের ভিতর আর ফুসফুসের প্রতিটি কোষে। নিজের মৃত্যুভয়কে আদৌ কোনো আমলেই নেয়নি এই মেয়ে। করোনা ভবনের সবচেয়ে ভয়দ ওয়ার্ড এই আইসিইউ। এখানে মৃত্যুবেশী করোনার রক্তলোহিত দক্ষিণ হস্তটি প্রতিটি বেডে ঘুরে বেড়ায় অহর্নিশ, কখন কাকে সে স্পর্শ করে তা কেউ ঠাহর করতে পারে না। কিন্তু অনি সদা সজাগ, করোনার হিমশীতল হাতের স্পর্শ যেন ওর বাবার শরীরে না লাগে সে জন্য ও জেগে থাকে বাবার পাশে সারাক্ষণ জাগরীর মতো। এই মেয়েটি ওর বাবাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য বুকের মধ্যে অবিনাশী আশা নিয়ে অহোরাত্র বসে থাকে বাবার বেডের পাশে। একদিকে বাবা আরেক দিকে মৃত্যু─এই দুইয়ের মাঝে অবিনাশী ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনিন্দিতা নামের এই মেয়েটি। প্রমেথিউজ যেমন করে মানবকল্যাণে স্বর্গ থেকে দেবতাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আগুন চুরি করে নিয়ে এসেছিল মর্ত্যে ঠিক তেমনি অনিন্দিতা নামের এই মেয়েটি যমরাজ্য থেকে শবের মিছিল ডিঙিয়ে জীবিত বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে চায়। সে ওর বড় ভাইকে কথা দিয়েছে যে করেই হোক সে তার বাবাকে দাদার কাছে ফিরিয়ে নেবেই। ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা আর ধনুর্ভঙ্গ পণ নিয়ে এই মেয়েটি এই করোনা ওয়ার্ডে থিতু হয়ে গেছে। করোনা আইসিইউ’র ভিতর সারা দিনরাত চলছে নিয়তির সাথে অনিন্দিতার নিত্য দ্বৈরথ। দেড় মাস ধরে এই মেয়েটি ওর বাবাকে নিয়ে করোনার সাথে খেলে যাচ্ছে জীবন-মৃত্যুর এক অসম গোপন খেলা।