‘চন্দ্রালোকে তুমি’ নামকরণটিই প্রতিভাত করে এ কাব্যগ্রন্থের উপস্থাপনাকৌশল। অবচেতন ভাবনালোকে অতীতের বেদনাকামনা খননপ্রচেষ্টা আছে প্রথম কবিতাটিতে। বহুমাত্রিকতার কূটাভাস এতে নেই; আছে স্বপনচারিণীকে স্মৃতির জানালা দিয়ে একবার দেখার অভিলাষ। রসসিক্ত স্তর থেকে কবি ফিরে তাকান কৈশোরিক পল্লিজীবনের পাখির গানে, নদীর কলতানে, ভ্রমরগুঞ্জনে, বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে, নদীকিনারায়, মাটির মমতারসে রূপরস বর্ণগন্ধস্পর্শঝদ্ধ শুদ্ধসুন্দর পবিত্র বাংলায়, যে-বাংলা যান্ত্রিকতানির্ভর ঢাকা নগরীতে সম্পূর্ণ আলাদা। একদিন যুবক হয়ে যাওয়া প্রোটাগনিস্টকে দোদুল্যমানতায় সংশয়চিত্ত করে ফেললেও তাকে শেষ পর্যন্ত নগরজীবনের রুক্ষ পেশাদারি জীবনের পথ বেছে নিতে হয়। গ্রামজীবনের মৌলিকত্ব মুছে-যাওয়া, রুক্ষতায় কেঁপে-থাকা, মোসাহেবির উদ্যত থাবায় বিপর্যস্ত সে-জীবন এক নবতর চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। 'উষ্ণ জোয়ার আলিঙ্গন' কবিতায় এই সন্ধিক্ষণের চিত্রায়ণ আছে: ‘একটি পাখি খুব নীরবে/হারিয়ে গেল হৃদয় থেকে,/একটি হৃদয় বন্ধ কপাট/হারিয়ে গেল অন্ধকারে।/আমি তাকে খুঁজে বেড়াই/বন্ধ ঘরে দূর নীলিমায়;/এতই যদি কষ্ট দেবে/কেন নিলে মনের কোলে?' রাজনীতিরসায়ন প্রসঙ্গটি যখন উত্থাপিত হয়, তখন কবি আরো সচেতন ও স্বদেশ ভাবনাময়। 'মতিহার' কবিতাটিতে তিনি জোহা হত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার। তিনি এ-পর্যায়ে 'শাবাশ বাংলাদেশ'-এর পাদপীঠে দাঁড়িয়ে শপথে শপথে উজ্জীবিত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মূল্যায়ন করার মধ্য দিয়ে কবি আরেক সংশয়ের দোলাচল উপস্থাপন করেন তাঁর ‘শান্তি চাই' কবিতায়। ‘উইপোকা’য় তিনি পরিপক্ব ও ক্ষিপ্ত। তিনি বলেন, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে খিচুড়ি,/পাতায় পাতায় দুর্নীতিবাজ।' এই নষ্ট সমাজে কত শাহেদ কত সাবরিনা/ঘুরে বেড়ায় দাপটে।' নৈরাশ্যের ঘন অন্ধকার যখন সমাজে ঘনীভূত হয়ে আসে, তখন কবি ব্যক্তিগত আশ্রয় সন্ধানের অজুহাতে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে সমাধান কল্পনা করেন। তিনি বলেন, এপাশ ওপাশ করছি/কিছুই ভালো লাগছে না:/খুবই অস্থির লাগছে। / মাথা কাজ করছে না। করোনা প্রসঙ্গ বাদ দিয়েই বলা যায়, কাব্যগ্রন্থটির পাঠে একটি পরিকল্পিত অগ্রগমন আছে, যা স্পষ্ট হয়ে উঠে 'রক্তক্ষরণ'-এ 'প্রভু, শাস্তি দাও তুমি/সকলের মঙ্গলের।/তুমি কৃষকের মজুরের/বঞ্চিত মানুষের/তুমি ধনীর আদরের দুলালের,/লম্পটের/তুমি আকার বিকার নিরাকার/ ভিন্নমতের। বস্তুবাদী চিন্তা ও ভাববাদী ভাবনার এক প্রকার স্বকপোলকল্পিত প্রত্যাশা লক্ষ করি এখানে কবির সমাজমনস্কতার কাব্যিক স্ফুরণ সফলতা লাভ করে তাঁর অবচেতন ও চেতন মনস্তাত্ত্বিক ধারাবাহিকতায়, যা আখেরে সমর্পিত চিরাচরিত ঈশ্বর বিশ্বাসে। এটা তাঁর দেশজ ভাবনারই প্রকাশ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। সমসাময়িকতার উপাদানে ধন্য এই অবিচ্ছেদ্য কবিতামালা পাঠকমহলের মনোযোগ আকর্ষণ করবে বলে বিশ্বাস করি। মোস্তফা তোফায়েল হোসেন কবি, অনুবাদক ও সমালোচক
মোহাম্মদ হানিফ জন্ম: ১ জানুয়ারি ১৯৭০, গাইবান্ধার কামারপাড়ায় নানাবাড়িতে । পিতা: বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: লোকমান আলী; মাতা: মোছা: হালিমা খাতুন। পৈতৃক নিবাস লালমনিরহাটের রত্নাই নদীর তীরে কর্ণপুর গ্রামে । শৈশব, কৈশোর ও বেড়ে ওঠা গাইবান্ধার কামারপাড়ায়। শিক্ষা: হিসাববিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ও এমবিএ । মোহাম্মদ হানিফ-এর লেখালেখির সূচনা স্কুলজীবন থেকেই। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি কামারপাড়া কলেজ প্রতিষ্ঠা ও কারমাইকেল কলেজ বিতর্ক পরিষদ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। রত্নাই নদী, কারমাইকেল কলেজ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, কর্মজীবন, নানামুখী সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন ঘটনা তাঁকে আলোড়িত করে। তিনি থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া ভ্রমণ করেছেন। জগৎ- সংসারের নানা চড়াই-উতরাইয়ে মোহাম্মদ হানিফ মানসিক প্রশান্তির জন্য বেছে নিয়েছেন কবিতা। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘যে ভাবনায় হৃদয় দোলে” (২০১০)। ‘চন্দ্রালোকে তুমি' কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ।