দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে নির্মলা সবার বড়। বাবা বিশিষ্ট উকিল—আয় প্রচুর, ব্যয় প্রচুরতর। নির্মলা সুন্দর, সুশীল এবং বিনাদোষে বিবাহের উপযুক্ত। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর আবগারী বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তা ভালচন্দ্র সিনহার পুত্র ভুবনমোহন সিনহার সাথে নির্মলার বিয়ের পাকা কথা হয়। কিন্তু বিয়ের মাত্র কয়েকদিন আগে হঠাৎ নির্মলার পিতা খুন হন এক দুষ্কৃতকারীর হাতে। উপন্যাসের আসল কাহিনির শুরু হয় এখান থেকেই। এখান থেকেই ‘নির্মলা’র নির্মলা হয়ে ওঠে রঙ্গমঞ্চের প্রধান পাত্র। পিতার মৃত্যুর সাথে সাথেই নির্মলার বিয়ের পাকা কথা কাঁচা বাঁশের কঞ্চির মতো ভেঙে যায়—সমাজের নির্মম নিয়মে। ষোড়শী নির্মলাকে বাবার বয়সি উকিল মুনশি তোতারামের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়—সমাজের নির্মম নিয়মে। পড়তি বয়সের প্রবীণ তোতারামের মনে উর্বশীর পাণিপীড়নের সাধ জাগে—সমাজের নির্মম নিয়মে। শুভাকাঙ্খি প্রতিবেশিরা মুনশি তোতারামের আগের তরফের তিন সন্তানকে নির্মলার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে—সমাজের নির্মম নিয়মে। তোতারামের সাধের সাজানো বাগান উজাড় হয়ে যায়, তাঁর তিন তিনটা ছেলে একে একে কালের গর্ভে হারিয়ে যায়—তাও সমাজের নির্মম নিয়মে। সামাজিক অবস্থানের উপর ভর করে মুনশি তোতারাম উর্বশীর পাণিপীড়ন করতে গিয়ে টের পান যে, বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করা যতটা সহজ, বাহুডোরে আবদ্ধ করা ততটা নয়। বালিকা বধুর মন পাওয়ার জন্য মুনশি তোতারাম কোনো পাথরই ওল্টাতে বাকি রাখেন না। দাম্পত্যবিজ্ঞানের বিবিধ সূত্র তিনি একের পর এক প্রয়োগ করতে থাকেন অবলা নারীর প্রবল প্রেম পাওয়ার আশায়। সুগন্ধি তেল, ঝালটক আচার, মিষ্টি মুরব্বাসহ হরেকরকম উপহার দিয়ে পরানবঁধুর মন ভজাবার চেষ্টা করেন তিনি। এক বাল্যবন্ধুর পরামর্শে বাহাদুরির গল্প ফাঁদেন বাল্যবধুকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য। কিন্তু যেই লাউ সেই কদু—প্রেমপিয়াসী প্রবীণ তোতারাম প্রেয়সীর প্রেম পেতে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থই থেকে যান। এদিকে নির্মলার মনেও শান্তি নেই। একদিকে বাবার বয়সী বুড়োভাম তোতারাম স্বামীর অধিকার নিয়ে সারাদিন ওর পাশে ছোঁকছোঁক করে। অন্যদিকে আরেক বুড়িÑ স্বামীর বড় বোন রুকমিণী—সংসারের কর্তৃত্ব হারানোর ভয়ে ঘরকে নরক করে তুলেছেন। নিজের ভাই ও ভাইপোদের অযথাই ক্ষেপিয়ে তুলেন নির্দোষ নিরপরাধ নির্মলার বিরুদ্ধে। এত কিছুর পরও নির্মলা কিছুটা শান্তি খুঁজে পায় স্বামীর আগের তরফের তিন সন্তান মান্সারাম, জিয়ারাম ও সিয়ারামের সাহচর্যে। মান্সারাম বয়সে নির্মলার সমান, লেখাপড়ায় ভালো, খেলাধুলায় পারদর্শী এবং দেখতে পাতলা ছিপছিপে কোমলকান্তি দেহ। নির্মল নিষ্পাপ মান্সারামের কাছে নির্মলা ধূধূ মরুভুমির মধ্যে একটু শ্যামল, শীতল আশ্রয় খুঁজে পায়। কিন্তু এ আশ্রয় অতিশীঘ্রই সন্দেহের ঝড়ে একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। মুনশি তোতারামের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে—নির্মলার সাথে মান্সারামের কোনো অবৈধ সম্পর্ক নেই তো? সন্দেহের জেরে একে একে নিঃশেষ হতে থাকে মুনশি তোতারামের সাধের সাজানো সংসার। সন্দেহের প্রথম শিকার মান্সারাম নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করার জন্য প্রায়-স্বেচ্ছামৃত্যু গ্রহণ করে। তারই পদাঙ্ক অনুসরণ একে একে মৃত্যুর এই মিছিলে যোগ দেয় কেন্দ্রীয় চরিত্রকে ঘিরে থাকা আরও অনেকেই। নির্মলার বিয়ের আগে নির্মলার পিতা বাবু উদয়ভানু লালের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যে ঘটনার সূত্রপাত, পুঞ্জিভূত দুঃখের প্রতিবিম্ব নির্মলার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে লেখক সেই গল্পের সমাপ্তি টানেন।