রুহানিয়াত সমৃদ্ধ দার্শনিক ভাবচর্চা আর সাহিত্যিক-রাজনৈতিক তত্ত্বচর্চাকে একসঙ্গে কবিতার দেহে ধারণ করতে সক্ষম ফয়েজ আলমের সহজিয়া কবিতা। বরাবরের মতো এই বইয়ের কবিতাগুলোতেও নান্দনিকতা আর উত্তর-উপনিবেশী তৎপরতা একদেহ ধারণ করেছে। তবে অনেক কবিতায় রাজনৈতিকতা তাঁর তাত্ত্বক গণ্ডি অতিক্রম করে তৎপরতার তেজ নিয়েও হাজির হয়েছে, এই দাবি করা যায়। ফয়েজ আলম তাঁর কবিতায় মানুষের প্রাত্যহিক মুখের ভাষার প্রতি উন্মুক্ত। যে ভাষাকে আমরা ব্রাত্য বানিয়ে রেখেছি একেই তিনি জায়গা করে দিয়েছেন কবিতায়। তাই প্রচলিত কাব্যভাষা থেকে তাঁর কবিতার ভাষা ভিন্ন। বিভিন্ন প্রবন্ধে তিনি এ ভাষাকেই বলেছেন মান কথ্যবাংলা, আঞ্চলিকতার বাইরে সর্বাঞ্চলীয় বাঙালির প্রতিদিনের মুখের ভাষা। কবিতাগুলো কখনও কখনও বিভিন্ন ধ্বনি ও শব্দে বেশি বা কম জোর দিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করতে পারে, যেভাবে আমরা হয়তো আড্ডার সময় কথা বলি। এবং তা একই সঙ্গে বক্তব্যের অতিরিক্ত ভাষারও অভিজ্ঞতা। খোদ ‘আওয়াজের সঙ্গে ইশক যেন। প্রাণের আকুতি ও চঞ্চলতার সঙ্গে তাই শূন্যতাও হাজির আছে। সেই সঙ্গে জারি আছে ‘শব্দের দিলের ভিতরে আরও শব্দের আশা’। রাইতের আগে একটা গান বইটি নিঃসন্দেহে ফয়েজ আলমের এক দীর্ঘ সফরের ফসল। আমার বিশ্বাস এই বইয়ের কবিতাগুলো পড়ার সময় পাঠকরাও এই সফরের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাবেন। এই সফর নান্দনিকতা, রাজনৈতিকতা ও রুহানিয়াতসমূহের বিভিন্ন পর্দা অতিক্রমণ ও নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সফর।
ফয়েজ আলমের চিন্তার ধরন, রোখ ও জায়গা আমাদের প্রচলিত ধারার সাহিত্যভাবনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা থেকে ভিন্ন। একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক, অনুবাদক, উত্তর-উপনিবেশী তাত্ত্বিকা উপনিবেশী শাসন-শোষণ আর তার পরিণাম, রাষ্ট্র ও সমধর্মী মেল কর্তৃক ব্যক্তির উপর শোষণ-নিপীড়ন ও ক্ষমতার নানামুখী প্রকাশ আর এসবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকার কৌশল নিয়ে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লিখছেন তিনি। বিশ্বায়নের নামে পশ্চিমের নয়াউপনিবেশী আর্থ-সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আর রাষ্ট্র ও স্বার্থকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর শোষণচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁর লেখা আমাদের উদ্দীপ্ত আর সাহসী করে তোলে। ফয়েজ আলমের জন্ম ১৯৬৮ সালে, নেত্রকোনা জেলার আটপাড়ার যোগীরনগুয়া গ্রামে। বাবা শেখ আবদুস সামাদ, মা সামসুন্নাহার খানম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (সম্মান) ও এমএ পাস করার পর প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষণার জন্য এমফিল, ডিগ্রি লাভ করেন ফয়েজ আলম। গুরুত্বপূর্ণ কাজ: ব্যক্তির মৃত্যু ও খাপ-খাওয়া মানুষ (কবিতা, ১৯৯৯); প্রাচীন বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি (গবেষণা, ২০০৪); এডওয়ার্ড সাঈদের অরিয়েন্টালিজম (অনুবাদ, ২০০৫); উত্তর-উপনিবেশী মন (প্রবন্ধ, ২০০৬); কাভারিং ইসলাম (অনুবাদ, ২০০৬), ভাষা, ক্ষমতা ও আমাদের লড়াই প্রসঙ্গে (প্রবন্ধ, ২০০৮); বুদ্ধিজীবী, তার দায় ও বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব (প্রবন্ধ, ২০১২), জলছাপে লেখা (কবিতা, ২০২১); ভাষার উপনিবেশ: বাংলা ভাষার রূপান্তরের ইতিহাস (প্রবন্ধ, ২০২২), রাইতের আগে একটা গান (কবিতা, ২০২২)।