মাহবুব আলম যে এই সময়ের প্রতিভাবান নাটককারদের সামনের সারিতে, গত কয়েক বছরে তা প্রমাণিত। ওঁর প্রথম প্রতিশ্র“তি এই রূপসুন্দরী। সামন্ততান্ত্রিক বাংলার বর্ণাঢ্য পটভ‚মিতে যে খাঁটি বাংলা মঞ্চনাটকের কর্ষণক্ষেত্র লুকোনো আছে সেটি মাহবুবের পূর্বসূরিদের কেউ কেউ প্রতিষ্ঠা করেছেন। লোকায়ত সংস্কৃতিকে মান্যতা দেবার পাশাপাশি হরেক কিসিমের কিংবদন্তিকে সার করে আধুনিকতার বয়ান তৈরি করায় মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। সদর-মফস্সলের টানাপোড়েনকে চিহ্নিত করেছেন। ইয়োরোপিয়ান ড্রামাটার্জিকে পাশে সরিয়ে রেখে বাংলার নবীন পলিমাটিকে উর্বরা জেনেছেন, গ্রাম্য বিনোদনের মধ্যে তার বিশিষ্ট মনটিকে নির্ণয় করেছেন। সর্বোপরি সেকাল-একালের ঘন বুনোটে এক ¯পন্দমান উত্তর-ঔপনিবেশিক জীবনের ছবি এঁকেছেন। মাহবুবকে ওঁদের সার্থক উত্তরসাধক মনে হয়েছিল। ‘রূপসুন্দরী’ নাটকটি নিবিড় পাঠের সুযোগ এলে বুঝলাম মাহবুবের আসল ওস্তাদি আঞ্চলিক ইতিহাসের নবীকরণে। প্রতœচিহ্নের মধ্যে দিয়ে আবহমান বাংলার খেই ধরতে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নানান অনুভবকে মঞ্চমায়ায় জারিয়ে নেওয়াতেই ওঁর আগ্রহ। চার বছর আগে ‘রূপসুন্দরী’র সমালোচনা লিখতে গিয়ে এর মর্মকথাকে ধরেছিলাম এই ভাষায়‘মহাস্থানগড়ের নামমাহাত্মর সঙ্গে মিলেমিশে আছে করতোয়া নদীর ধারে শীলাদেবীর ঘাট। সেই ঘাটের সঙ্গে জুড়ে থাকা কিংবদন্তিকে একবার ছুঁয়েই নাটক চলে এল শতখানেক বছর আগেকার বাস্তবতায়। সেখানে গ্রামের জোয়ান চাষি ছলিম আর চুড়িওয়ালি সুন্দরীর প্রেমের পথে কীভাবে বাধা হয়ে দাঁড়াল এক আঁটকুড়ো তালুকদারের লম্পট প্রবৃত্তি আর কিংবদন্তির রানি শীলাদেবীর দেখানো পথে ‘ইজ্জত’ বাঁচাতে কীভাবে করতোয়ার বুকে প্রাণ সঁপে দিল এক নারীতারই কিসসা শোনাল ‘রূপসুন্দরী’। প্রমিত বাংলার সঙ্গে উপভাষাকীর্ণ বাংলার একটি চোরা লড়াই আধুনিক মঞ্চনাটকের অন্যতম উপজীব্য। বিশেষত বাংলাদেশে। মাহবুবের কলমে সেটি চমৎকার খোলে। ভাষার স্থানিক গুণাগুণকে বজায় রেখেই, তার কথোপকথনের স্বতন্ত্র চালকে মাথায় নিয়েও সব ধরনের বাঙালির মনের কাছে পৌঁছনোর কঠিন কাজে ব্রতী হয়েছেন মাহবুব। মাহবুব আলমের মতো নাটককার সেই উদার আকাশের সন্ধানী। গভীর ইতিহাসবোধ নিয়ে এই আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জকে আঁতিপাঁতি করে চেনানোই ওঁর অভীষ্ট।