বাংলা ভাষায় বহুল চর্চিত বিষয়ের অন্যতম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্র বাক্যবিহীন আমাদের সম্ভাষণ হয় না, কাউকে বিদায় দেয়া যায় না, প্রেম নিবেদন চলে না, আমাদের আহার, নিদ্রা, বিহারের নিত্যসঙ্গী রবীন্দ্র সাহিত্য। বাংলা ভাষায় রবীন্দ্র চর্চা আমাদের মতো অর্বাচিনের হস্তে পড়ে নিজেদের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু গান, নির্বাচিত কিছু কবিতা, বহুল পঠিত প্রবন্ধ, অবসরে গল্পগুচ্ছের মজাদার কোটেশনের ঘেরাটোপে আটকে আছে। বিশ্বকবির সার্ধশততমবার্ষিকীতে দুই বাংলায় কতক প্রতিষ্ঠান বিষয়ভিত্তিক নানা স্বাদের রচনা প্রকাশ করেছিল। আমাদের চর্চার সীমাবদ্ধতায় রবীন্দ্র সাহিত্যের মহাসাগরের নুড়ি নাড়াচাড়ার অধিক আমাদের সক্ষমতায় কুলোয় না। মহাসমুদ্র সিঞ্চনের তাই রয়ে যায় বাকি। রবীন্দ্র ভক্তকুলের প্রেমের আতিশয্যও রবীন্দ্রনাথকে শতরূপে শতবার দেখার পথে দুর্লঙ্ঘণীয় দেয়ালসম হয়ে থাকে। এমনই এক বাস্তবতায় রবীন্দ্র চিন্তায় গণমাধ্যমের খোঁজে আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস।
রবীন্দ্রযুগে গণমাধ্যম বলতে শুধুমাত্র সংবাদপত্র সাময়িকপত্র বোঝাতো। বর্তমানে গণমাধ্যমের বিস্তৃতি ঘটেছে। সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন থেকে হালের সামাজিক মাধ্যম পর্যন্ত। তারপরও এখন থেকে প্রায় দেড়শত বছর পূর্বে গণমাধ্যম নিয়ে রবীন্দ্রনাথের পর্যবেক্ষণ এখনও দারুণ প্রাসঙ্গিক।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালে কলকাতার জোড়াসাকোর ঠাকুর পরিবারে। মৃত্যু ১৯৪১ সালে। বাংলা তথা বিশ্ব সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম পুরুষ। চর্যাপদ থেকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বিবেচনায় নিলে রবীন্দ্রনাথে এসে সেটি একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পরিগ্রহ করে। রবীন্দ্রনাথ তার চিন্তা, কর্ম, লেখনির মাধ্যমে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর এহেন কোনো অনুভূতি নেই যেটি ছুঁয়ে যাননি। সাহিত্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি; ব্যক্তির পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে কখনো শিল্পীর, কখনো লেখকের, কখনো পর্যবেক্ষকের, কখনো কবির, কখনো দার্শনিকের দৃষ্টি ফেলেছেন। তার সুবিস্তৃত লেখনি কখনো কবিতায়, কখনো পদ্যে, কখনো গদ্যে, কখনো প্রবন্ধে, কখনো অনুবাদ কর্মে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথের সময়কাল ছিল বঙ্গের জন্য ব্রিটিশ রাজের শাসনের সময়। তার জন্মের ৪ বছর পূর্বে সিপাহী বিদ্রোহ হয়। ব্রিটিশ রাজ কোম্পানি শাসন থেকে নিজ হস্তে নিয়ে নেয় ভারতশাসনের ভার। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের ৬ বছর পর ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যায়। রবীন্দ্রনাথের জীবনকাল এবং তার রচনাপাঠ ১৯ ও ২০ শতকের বাংলাকে বোঝার জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এ পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের কাজ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের সমাজচিন্তা, রাষ্ট্রচিন্তা, শিক্ষাচিন্তা, অর্থনীতিচিন্তা নিয়ে দুই বঙ্গে অনেক প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের গবেষণা রয়েছে। রবীন্দ্র সময়কালে এ বঙ্গে পত্রিকা, সংবাদপত্র, সাময়িকপত্রের বিকাশ হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজে পারিবারিকভাবে সাধনা, ভারতী এসব পত্রিকা প্রকাশের সাথে যুক্ত ছিলেন। নিয়মিত সংবাদ সাময়িকী পত্রে লেখা পাঠাতেন। সংবাদ সাময়িকীপত্রে ছাপানো প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প, উপন্যাসের সমালোচনা লিখতেন। শুধু তাই নয় ব্রিটিশরা যখন ১৮৯৮ সালে সংবাদপত্রের ও মুক্ত চিন্তার কণ্ঠরোধ করতে সিডিশন বিল পাস করে তখন কলকতার টাউন হলে বক্তৃতা রাখেন। তার লেখনিতে প্রায় খবর, সংবাদ, সাময়িক পত্র, রিপোর্টার, সম্পাদক, কণ্ঠরোধ, ছাপাখানা এসব শব্দ এসেছে।
এই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের গণমাধ্যম চিন্তায় আলোকপাত করা হয়েছে।