ফ্ল্যাপের লেখা: পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বাহিনীর এলিট গ্রুপ 'স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ (এসএসজি)-এর সদস্য মাহফুজ আলম বেগ এর পোস্টিং ছিল করাচিতে। প্রতিরক্ষা বাহিনীতে একজন চৌকশ প্যারাট্রুপার, দক্ষ ফ্রগম্যান, দুর্দান্ত সার্ফার, সেরা বক্সার এবং জুডো-কারাতে পারদর্শী হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিলেন তিনি। অসীম সাহসিকতা ও উপস্থিত বুদ্ধির বলে প্রতিরক্ষা বাহিনীর এক অফিসারের বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। তাঁর অনন্য সাহসিকতার জন্য তাঁকে পাক প্রেসিডেন্ট কর্তৃক শান্তিকালীন সময়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীর রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান 'তকমায়ে বাসালত’ খেতাবে ভূষিত করা হয় । এলিট গ্রুপ এসএসজি-এর কমান্ডো হওয়ার সুবাদে করাচির নৌবন্দরে মাহফুজ আলম বেগ-এর ছিল অবাধ যাতায়াত। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে তার নজরে আসে, করাচি বন্দরে নেভির জাহাজে বিপুল পরিমাণ স্থলযুদ্ধের উপযোগী অস্ত্র বোঝাই হচ্ছে । বুঝতে পারেন, এই অস্ত্র পূর্ব পাকিস্তানে ব্যবহারের জন্য জাহাজে তোলা হচ্ছে। এর আগে করাচিতে তিনি জড়িত ছিলেন লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন-এর নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী গোপন বিপ্লবী দলের সঙ্গে। করাচির রণসজ্জায় মাহফুজ আলম বেগ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন, পালিয়ে জন্মভূমি পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসবেন। সশস্ত্র বিদ্রোহে অংশ নেবেন। কোর্ট মার্শালের সম্মুখীন হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই তিনি ৩রা মার্চ ১৯৭১ পালিয়ে ঢাকায় আসেন । সাক্ষাৎ করেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। করাচির রণসজ্জার কথা অবহিত করেন বঙ্গবন্ধুকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াস গ্রুপের রূপকল্প 'বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স'-এর সামরিক শাখার প্রধান প্রশিক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হয় মাহফুজ আলম বেগকে। দায়িত্ব নিয়ে প্রথমে তিনি নারায়ণগঞ্জ ও পরে কলাতিয়ায় গগনের বাড়িতে ছাত্র-যুবকদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেন। ২৫শে মার্চের ভয়াবহ গণহত্যায় ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঢাকা থেকে পালিয়ে কলাতিয়ায় গগনদের বাড়িতে ওঠেন ও পরে ভারতে গমন করেন। মাহফুজ আলম বেগ প্রথমে নরসিংদীর কড়াইতলায় ক্যাপ্টেন মতিউরের নেতৃত্বে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন। তারপর নিজ জেলা বারিশালে এসে দায়িত্ব নেন ছাত্র যুবকদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের। বরিশাল শহরের পতন হলে ৩০/৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চলে যান স্বরূপকাঠির আটঘর কুড়িয়ানায়। এখানে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধের মূল স্রোতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য জুন মাসের প্রারম্ভে চলে আসেন ভারতে। মেজর এম এ জলিলের অধীনে নবম সেক্টরে যোগ দিলে তাকে কৈখালী ও সমসেরনগর অপারেশন ক্যাম্পের দায়িত্ব দেয়া হয়। হিঙ্গলগঞ্জ ক্যাম্পের অপারেশনাল কমান্ডারের দায়িত্বও পান। শুরু হয় সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তার যুদ্ধ-জীবন । নবম সেক্টরের অধীন বিশাল সীমান্ত এলাকা জুড়ে চল্লিশটার উপর পাকিস্তানি সৈন্যের বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট (বিওপি) ও মিলিটারী ক্যাম্প। প্রায় প্রতিটি রাতে পাকিস্তানিদের কোনো না কোনো বিওপির উপর মাহফুজ আলম বেগ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আক্রমণ করেছেন। রাতের বেলা তাদের ব্যতিব্যস্ত রেখেছেন, গুলি খরচ করিয়েছেন । রাতের ঘুমের বিঘ্ন ঘটিয়ে মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যয়ে ফেলার কৌশল গ্রহণ করেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা জানতে পারে তাদের এলাকায় বেগ নামে একজন এসএসজি গ্রুপের সদস্য রয়েছেন যে কিছুদিন আগেও তাদের একজন ছিল। মুক্তি বাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণে অতিষ্ট হয়ে তারা মন্তব্য করে, রাতটা বেগ-এর আর দিনটা আমাদের। বেগকে নিয়ে তারা কত যে উৎকণ্ঠা ও পেরেশানির মধ্যে ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় আগস্ট মাসের ২০ তারিখে শ্যামনগরে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধের পরে। পাকিস্তানি গণমাধ্যম ফলাও করে প্রচার করে, এই যুদ্ধে লে. বেগসহ ৫১ জন বিপথগামী দুষ্কৃতকারী নিহত হয়েছে। যদিও এই খবরের সত্যতা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধে মেজর জলিল-এর ভূমিকা ও নবম সেক্টরের নানা অজানা তথ্য, যুদ্ধ কাহিনী পাঠকরা এই গ্রন্থ পাঠে জানতে পারবেন।