ভূমিকা: কবি কখন, কবে, কেমন করে তাঁর নির্মাণকলার বিষয় ও অবকাঠামোকে নতুন নতুন চিন্তায় ঋদ্ধ করে তুলবেন, একমাত্র কবিই তা জানেন। কবির মনে যদি প্রশ্ন না থাকে, তা হলে তাঁর সৃষ্টিশীলতার সংগোপন অনুরাগ কেমন করে পাঠক-হৃদয়কে বিস্ময়-বিমোহিত করে তুলবে? ক্ষণকালের কবি যারা, তারা নিকটের সহজ পথের ভিখিরি, কিন্তু যারা মহাকালের সীমানাকে অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চান, তারা নতুন বিষয়কে নতুন শিল্পকলার আধার করে তুলতে গিয়ে কাব্যে নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টিতে সক্ষম হন। কথাগুলো মনে হলো কবি জান্নাতুন নিসার ‘সত্যিই কি কিছু আছে' কাব্যগ্রন্থের কবিতাটি পড়তে গিয়ে। আপাতভাবে তার কবিতাটিকে জটিল বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তার অন্তগূঢ় রহস্য উন্মোচন করতে পারলে পাঠক এর মধ্যে খুঁজে পাবেন জীবনের নানামুখী প্রশ্ন ও তার উত্তর। এই শ্রমসাধ্য কবিতার প্রতিটি স্তবক ও পঙ্ক্তিতে আছে ব্যক্তিক চরিত্র, সামগ্রিক জীবনাচরণ, সময় ও কাল এবং ভাষাবিন্যাসের যৌক্তিকতাসহ নানা বিষয়ে প্রশ্ন। আছে সেই প্রশ্নের ধ্বন্যাত্মক ও ঋণাত্মক উত্তরও। এই কাজটি করতে গিয়ে কবি নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। এ-ধরনের কাজে অনেক ঝুঁকি নিতে হয়। নতুন কিছু করতে গেলে সেই অনিবার্যতার পথের অনুসারী না হয়ে উপায় নেই। এতে পতনের সম্ভাবনা থাকে বলে অনেক কবিই তা না করে গতানুগতিক পথের দিকেই তাদের অভিসারকে অব্যাহত রাখেন। তাতে কৌলিন্য রক্ষা হয় বটে, কিন্তু নতুন কাব্যিক অভিযাত্রা সম্ভব হয়ে ওঠে না। জান্নাতুন নিসা এ-ব্যাপারে ঝুঁকি নিয়েছেন। শুধু চিন্তার ক্ষেত্রে নয়, ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। ক্রিয়াপদে যেমন, তেমনি বিশেষ্যকে অব্যবহৃত নতুন বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও নিয়েছেন অবাধ স্বাধীনতা। এটা কবিদের অধিকার। প্রাচীন কাব্যকলা কিংবা আধুনিক কাব্যরচনার ক্ষেত্রেও অনেক কবিই এই স্বাধীনতা গ্রহণ করেছেন। এটা স্বেচ্ছাচার নয়, কবিতাকে নতুনত্ব দানের নিবিষ্ট প্রয়াস। বৈয়াকরণরা কিংবা অতিরিক্ত বিশুদ্ধতাবাদীরা একে সহজে মেনে নিতে চাইবেন না; কিন্তু কবি যেহেতু ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ পূরণের জন্যে নয়, কাব্যিক অভিনবত্বের জন্যে এই প্রয়াসে লিপ্ত হয়েছেন, তখন তার নিরীক্ষাকে গ্রহণ করতে পাঠকের দ্বিধা থাকলে তা কাব্য নির্মাণের নতুন পথের যাত্রীকে নিরুৎসাহিত করার শামিল হবে। অবশ্যই এটা মনে রাখতে হবে, নতুন কাব্যকৌশল ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা ও অনুধ্যান জরুরি। তা না হলে নতুনত্বের নামে এক ধরনের উদ্ভট কাব্যপ্রয়াস কবিতার সামগ্রিক ক্ষতি করতে পারে। জান্নাতুন নিসা এ-ব্যাপারে সতর্ক ছিলো বলেই আমি মনে করি এবং এটাও বিশ্বাস করি, এই কবিতা পাঠ করতে গিয়ে পাঠকরা বিভ্রান্ত না হয়ে বরং এক ধরনের নতুন ব্যঞ্জনের আস্বাদ লাভ করতে পারবেন। সে-ক্ষেত্রে অম্লমধুর অভিজ্ঞতা যদি কারোর হয়, তাহলে বুঝতে হবে, কবি তাঁর সৃষ্টিশীলতায় অনেকটাই সার্থক হয়েছেন। জান্নাতুন নিসার বর্তমান কাব্যগ্রন্থ 'সত্যিই কি কিছু আছে? পাঠককে সেই আস্বাদন লাভের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত করবে না বলেই আমি আস্থা রাখি। কবির কাব্যিক নিরীক্ষা সফল হোক এবং পাঠকের সাদর ভালোবাসা লাভ করুক, এই আমার একান্ত কামনা। অসীম সাহা
কবি-গদ্যকার-সাংবাদিক-সংগঠক জান্নাতুন নিসা বর্তমান সময়ের সুপরিচিত একটি নাম। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সমাপনের পর নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে। এছাড়া তিনি ফাইন্যান্স এবং হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (এইচআরএম) মেজর নিয়ে এমবিএ সম্পন্ন করেছেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন শিক্ষা-শিল্প-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। সহজ-সরল-সাবলীল ভাষায় শব্দের পর শব্দ গেঁথে গদ্য-পদ্যের যে সমাহার তিনি ইতোমধ্যে রচনা করেছেন তা পাঠক সমাজে বেশ সমাদৃত হয়েছে। মনের বিচিত্র অনুভূতি, কল্পনা, ভাবনা, জীবনবোধ, শিল্পচেতনার মতো মননশীল বিষয়ের সুন্দরতম অভিপ্রায় প্রকাশ পায় তাঁর লেখায়। তিনি লেখায় উপজীব্য করে তোলেন—মানবিক সম্পর্ক, প্রকৃতি, পরিবেশ, দর্শন, মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক অসঙ্গতি, অন্যায়, কুসংস্কার, মানবতাবাদ, স্বদেশপ্রেম, শিল্প-সংস্কৃতির নানা বিষয় । তার সত্তায় রয়েছে নান্দনিক সৃজনশীলতা; যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে পেশাগত জীবনে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে—‘নান্দনিক সৃষ্টিতে অবিচল...' স্লোগানে প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রকাশনা সংস্থা ‘য়ারোয়া বুক কর্নার'।