তেষট্টি বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কালি আর কলমের পাশাপাশি হাতে তুলে নিয়েছিলেন রঙ আর তুলি। সেটাই ছিল তাঁর শব্দের ভুবন থেকে আকারের জগতে মহাযাত্রার সূচনা। কবি নিজেই বলেছেন চিত্রকলা তাঁর শেষ বয়সের প্রিয়া। আক্ষরিক অর্থেই চিত্রকলা ছিল রবি জীবন সংগীতের শেষ সুর। শুরুটা হয়েছিল ১৯২৪ সালে, কিন্তু এরপর আর তিনি পেছনে ফিরে তাকাননি, মাত্র ষোল বছর সময়ের মধ্যে সৃষ্টি করে গেছেন আড়াই হাজার পেইন্টিংয়ের বিশাল জগৎ। সময় আর দ্রুততার নিরিখে এ যেন এক মহাবিপ্লব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রজগতে প্রবেশ ছিল অনেকটা আগ্নেয়গিরির অগ্নিবৃষ্টির মতো। আগ্নেয় উচ্ছ্বাসের মতোই তাঁর কলম আর তুলির শিরোদেশ থেকে ছবি বেরিয়ে এসেছিল অজস্র ধারায়। রবীন্দ্র চিত্রকলা এক কথায়-বিপুল তরঙ্গ রে। জীবনের কোনো শিক্ষার ক্ষেত্রেই বিশুদ্ধ একাডেমিক শিক্ষণ পদ্ধতির নিরেট রূপটি রবীন্দ্রনাথ কখনো গ্রহণ করেননি। এই আদর্শের ব্যত্যয় ঘটেনি চিত্রকলায়ও। উপমহাদেশের চিত্রকলার নির্বেগ আর বিশিষ্টতাবর্জিত সনাতন নীতির ধারা থেকে বিযুক্ত হয়ে যুগসন্ধিক্ষণে ভারতবর্ষের চিত্ররীতিতে বিবর্তন ও বিপরিবর্তনের মানসেই তাঁর চিত্রী হয়ে ওঠা। তিনি অক্ষরণশীল আর নিরুদ্ধ ভারতীয় পেইন্টিংকে আধুনিকতার সরণিতে তুলে এনেছিলেন প্রায় এককভাবে এবং প্রশ্নাতীতভাবে তিনিই এই উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক শিল্পী। রবীন্দ্রনাথের অঙ্কনশৈলী ছিল ভারতীয় চিত্রকলার খোলনলচে বদলানো রীতি। তাঁর রূপ সৃষ্টি ছিল গতানুগতিক, সনাতন এবং চিরাচরিত প্রথাবিরোধী। তাঁর ছবিতে আছে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মেলবন্ধনের ছায়া। তাঁর সৃষ্টির উৎস ছিল প্রাচী কিন্তু দৃষ্টি ছিল প্রতীচীতে। রেখা আর রঙের সংমিশ্রণে প্রচলবিরোধী ছবি এঁকে তিনি এমন এক ধারার সূচনা করেন যা সর্বতোভাবে না ভারতীয়, না ইউরোপীয়। কার্যত তিনি ভারতবর্ষের প্রথম ঐতিহ্যছুট শিল্পী। তবে প্রশ্ন উঠতেই পারে রবীন্দ্রনাথ কোন ঘরানার চিত্রী? সহজ কথায় এই কঠিন প্রশ্নের যুক্তিযুক্ত এবং যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর দেয়া দুরূহ। তাঁর ছিল স্বকীয় অঙ্কনশৈলী-স্বদেশি বা বিদেশি কোনো ঘরানার চিত্ররীতিই তিনি সরাসরি অনুসরণ করেননি। রবীন্দ্রচিত্রে স্বোপার্জিত বেশ কিছু মৌল এবং স্বকীয় গুণ আছে যেগুলো তাঁর সৃষ্টিকে অন্যদের জগৎ থেকে নিষ্প্রমাদভাবে আলাদা করে ফেলে দেয়। তাঁর ছবির জগৎ কোনো বিশেষ ‘ইজম’ এর চাঁদোয়ার নিচে নেই। ছবি আঁকায় তিনি উপমহাদেশের পরম্পরীণ কোনো ঐতিহ্যকেই শতভাগ তাঁর তুলির ডগায় ধারণ করেননি। তাঁর সৃষ্টিসম্ভারকে ‘নাঈভ’, ‘প্রিমিটিভিজম’, ‘এক্সপ্রেশনিসটিক’, ‘ইন্ডিয়ান’ কিংবা ‘ওয়েস্টার্ন’ কোনো একক ঘরানার বন্ধনীতে ঘেরা যাবে না। রবীন্দ্রনাথের সমকালীন সময়ে ইউরোপে ব্যাপ্তি লাভ করা ‘ইমপ্রেশনিজম’, ‘পোস্ট-ইমপ্রেশনিজম’, ‘কিউবিজম’, ‘ফভিজম’, ‘সুররিয়ালিজম’ ঘরানাগুলো থেকেও তাঁর শৈলী বেশ দূরবর্তী। কোনো রীতিই সরাসরি প্রতিফলিত হয়নি তাঁর চিত্রধারায়। রবীন্দ্রচিত্রে পাশ্চাত্য ঘরানাগুলোর যেটুকু প্রভাব বিদ্যমান তা অত্যন্ত প্রচ্ছন্ন, তবে সেটুকু দিয়ে তাঁর সৃজিত অনেক ছবি ব্যাখ্যা করা যায়। নিঃসন্দেহে তিনি মডার্নিস্ট কিন্তু সেই আধুনিকতা পাশ্চাত্য রীতির সংজ্ঞাতেও পুরোপুরি ব্যাখ্যেয় নয়। পেইন্টিংয়ে আধুনিক মনঃসমীক্ষণের সবচেয়ে সফল প্রয়োগ হয়েছে রবীন্দ্র চিত্রকলায়। রবি চিত্রকলা হলো প্রাণবন্ত শক্তি আর মেধার বিস্ময়কর প্রকাশ। চিত্রকলাকে আধুনিকীকরণ করে তিনি উপমহাদেশের শিল্পকলার গলিপথকে উন্নীত করে গেছেন রাজপথে। শুধু ভারতবর্ষে নয়, সমগ্র বিশ্বের নিরিখেই রবীন্দ্র চিত্রকলা একমেবাদ্বিতীয়ম।