স্বাধীনতা-উত্তর পূর্ব পাকিস্তানে এক বাবা তার বড় মেয়ের সাথে বসে গল্প করেন। বাবা বলেন আপন ভাষার মহিমা, জাতি হিসেবে দাঁড়াবার জন্য ভাষিক স্বাধীনতার ভূমিকা, ভাষা আন্দোলনে নিজের অংশগ্রহণের সেই দিনগুলো। আর বাবার সেই গল্পকথা মুহূর্তের মধ্যে মেয়ের মনে ঢেউ তুলে দেয়। প্রীতিলতার জীবনী সামনে রেখে যে মেয়ে বড় হয়ে উঠেছে, তার মন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে অনাবিল আশায়। সে বুঝতে পারে পাকিস্তানে ওরা স্বাধীন নয়। পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার আশা বুকে ধুকপুক করে ওঠে। বারবার সে ভাবতে থাকে তার জন্ম বৃথা যাবে না। দেশের জন্য সেও প্রীতিলতার মতো জীবন উৎসর্গ করতে পারবে। এই কিশোরী কোনো কাল্পনিক গল্প-উপন্যাসের চরিত্র নয়, তেমনি এইসব ঘটনা কোনো কল্পকথার অংশ নয়, এক নারী মুক্তিযোদ্ধার জীবনের প্রকৃত বাস্তব ঘটনা। আর এই কিশোরী আর কেউ নয়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির অত্যন্ত পরিচিত ও অসীম সাহসী নেত্রী লুতফা হাসীন রোজী। তিনি যেভাবে অত্যন্ত সরল প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করেন অপারেশন সার্চলাইটের বাস্তব অভিজ্ঞতা, তেমনি তার মা-বাবাকে চিঠি লিখে রেখে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার, একের পর এক শ্বাসরুদ্ধকর সব গেরিলা কাহিনি। তার মধ্যেও রয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রতিশ্রæতিবদ্ধতা, গ্রামবাংলার মানুষের সরলতা, মানবিকতার উল্লেখ, কৌতুক, সহযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা, আর মৃত্যুকে নিদারুণ কাছ থেকে দেখার রূঢ় বাস্তবতা। লুতফা হাসীন রোজী যতটুকুই বর্ণনা করেছেন, তার বর্ণনায় যেমন সততা ও বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখার চেষ্টা রয়েছে, যা তার গ্রন্থ ও তথ্যপঞ্জি ব্যবহার থেকেই আমরা বুঝতে পারি, তেমনি রয়েছে পরিপক্ব এক আবেগের বাস্তব ব্যঞ্জনা। তাই এ বইটি যেমন ইতিহাসের বিরল সম্পদ তেমনি ভাষা ও সাহিত্যের এক বৈভব হয়ে উঠবে বলে আমরা আশাবাদী। তিনি এর আগেও বই প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এবারই রোজী কয়েকটি পর্বে প্রথম তার মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অভিজ্ঞতাসমূহ লিখছেন। এই পর্বে ১৯৭১ সালে তার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ঘটনাসমূহ অত্যন্ত সুনিপুণ হাতে প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি তার জীবন থেকে তুলে এনে বর্ণনা করেছেন। অন্য পর্বগুলোতে রয়েছে তার জীবনের অন্যান্য সব সাহসী অভিজ্ঞতার ও বিচিত্র ঘটনার সমাহার। বাঙালি জাতির ও বাংলা ভাষাভাষীর কাছে এ বইটি পাঠকপ্রিয়তা পাবে বলে আমরা আশাবাদী।