মিশন শেষ করে দেশে এসেছি। কিন্ত মিশনের ঘোর যেন কাটতে চাচ্ছে না কিছুতেই। ১/২ মাস যাওয়ার পরও শুধু মিশনের কথাই ভাবি। যেসব সহকর্মীর সাথে হৃদ্যতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, তাদের সাথে কাটানো সময়গুলো যেন সব সময় অনুভব করছি। কি মুশকিল! ফেসবুকে আগে ছোটখাটো লেখা লিখলেও, তখন মিশন নিয়ে লেখার একটা তাড়া ভীষণ ভাবে অনুভব করলাম। মনে হলো, একমাত্র লেখালেখি করলেই বোধহয় মাথা থেকে মিশন তাড়াতে পারব। মানুষ খুব অদ্ভুত! যেসকল সহকর্মীর সাথে বছর দেড়েক আগেও ঠিকমতো জানাশোনা ছিলো না, মিশনে তারাই খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠলো। ইতি, ফরিদ, রফিক, রত্না, রহিমা, মোস্তফা, আশিষ এবং উদয় কালচারালের সদস্যরা ছিল আমার আনন্দ-বেদনার সঙ্গী। এমনও অনেক দিন গেছে, আকাশ জুড়ে ঘন মেঘ করেছে, সেই মেঘের সাথে মনটাও বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে। রত্নাকে বললাম, ‘একটা গান ধরো’। খুব সুন্দর গায় মেয়েটা। কত গান একসাথে করেছি আমরা! কী সুন্দর স্মৃতি! কেন যেন কষ্টের স্মৃতি মনে পড়ে না। সুখের স্মৃতিই চারপাশে ঘোরাঘুরি করে। কখনো হয়তো বা ভরা পূর্ণিমার রাত। শ্রীমা ডিউটি করছে লেভেল ২ হাসপাতালে। আমি গাড়ি নিয়ে হাজির ওখানে। ওরা চানাচুর, মুড়ি মাখাচ্ছে, আমার সাথে খাবে তাই। খোলা আকাশের নিচে, লেভেল ২ এর খোলা মাঠে মুড়ি খাওয়া, গানের আসর; সবই এখন স্মৃতি। দেশে ফিরে, ব্যানএফপিউ ক্যাম্পের মাঠের এক কোনায় সদ্য তৈরি সাংস্কৃতিক মঞ্চে এলোমেলো গান গাওয়া আমার তুফান সাংস্কৃতিকের সদস্যদের মিস করতাম খুব। মিস করতাম আমার ব্যাডমিন্টন খেলার বন্ধুদের। ওরাও ফোন করে বলত, ‘স্যার এতো কষ্ট হয় কেন আপনাদের ছেড়ে থাকতে?’ মিশন চলাকালীন ছুটিতে দেশে এসেছি। ব্যাচমেট শরীফ ফোন করে বললো, ‘অনেক কষ্ট করেছেন ৫ মাস। আর না। একটা সারপ্রাইজ আছে আপনার জন্য।’ ছুটি থেকে ফেরার পর দেখি, বেচারা ইউএন-এর বিভিন্ন অফিসে অনেক দৌড়ঝাঁপ করে আমার জন্য ইট-সিমেন্টের একটি মঞ্চ তৈরি করেছে, যাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সুন্দরভাবে করতে পারি। বিগত ১১টা রোটেশনের থেকে নিজেকে তখন অনেক ভাগ্যবান মনে হয়েছে মঞ্চটি দেখে। আমার ব্যাচমেট আমাকে এতোটা অনুভব করে। ভাবতেই আনন্দ হয়েছে খুব। এইসব ছোট ছোট আনন্দ বেদনা নিয়ে লিখতে খুব ইচ্ছে হলো। ফেসবুকে ‘লং রেঞ্জ পেট্রোল’ প্রথম লিখলাম। প্রথম লেখাতেই অনেকের উৎসাহ পেলাম। এরপর ডিআইজি শামীমা বেগম স্যার, পুলিশ সুপার মাহ্ফুজা লিজা স্যারের অনুপ্রেরণা, উৎসাহে কঙ্গো মিশনের স্মৃতি নিয়ে একটা বই প্রকাশের তাড়া অনুভব করলাম। ছোট ভাই আরিফ রহমানের উৎসাহ তো ছিলই (লেখক-ত্রিশ লক্ষ শহীদ বাহুল্য না বাস্তবতা এবং সিনিয়র নিউজরুম এডিটর, একাত্তর টিভি)। ১৮ মে ২০১৮ মিশনের যাত্রা শুরু। ইতিমধ্যে ১১টা কন্টিনজেন্ট সেখানে মিশন করে এসেছে। আমি ছিলাম ১২তম রোটেশনের ডেপুটি কমান্ডার। এখন সেখানে ১৫তম রোটেশন চলছে। ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর রাজধানী কিনশাসা-তে বাংলাদেশ পুলিশের ফিমেল কন্টিনজেন্ট অত্যন্ত সুনামের সাথে কাজ করছে। সেখানে আমাদের ফিমেল পুলিশ বিভিন্ন ধরনের পেট্রোল ডিউটি ছাড়াও পুলিশ কমিশনারের অফিসে ২৪ x ৭ ঘণ্টা নিরাপত্তা দিয়ে আসছে । এক বছরের বহু ছোট ছোট ঘটনা আছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখব। আনন্দের সাথে কষ্টও আছে বহু। সবচেয়ে বেশি কষ্টের সময় পার করেছি মিশন শেষ হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে। বাংলাদেশ পুলিশের দ্বিতীয় নারী অতিরিক্ত আইজিপি রওশন আরা বেগম পিপিএম, এনডিসি স্যারের কিনশাসায় আকস্মিক দুর্ঘটনা কবলিত মৃত্যু শোকার্ত করে তুলেছিল পুরো কন্টিনজেন্ট-কে। এই ক্রান্তিকালীন সময়ে ইউএন-এর পুলিশ কমিশনার স্যার ছাড়াও কিনশাসায় কর্মরত ইউএন-এর প্রত্যেক সদস্যের সহানুভূতি ও সহযোগিতা পেয়েছি শতভাগ। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি; কিন্তু সবার সহমর্মিতা যেন একসূত্রে গাঁথা। এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে এই সময়টা আমি পার করেছি। একদিকে প্রিয়জন হারানোর বেদনা, অপরদিকে এই দুঃসময়ে বিদেশি সহকর্মীদের ভালোবাসা, সহমর্মিতা আমাকে নতুন অনুভূতি, নতুন অভিজ্ঞতার দিকে চালিত করেছে। এই বইয়ের মাধ্যমে সেইসব বিদেশী সহকর্মীর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। রওশন স্যারের মতো স্নেহময়ী একজনের শেষ কাজগুলো নিজের হাতে করতে গিয়ে বারবার আবেগাপ্লুত হয়েছি। আমার মনে হয়েছে, স্যারের শেষ সময়গুলো লেখায় নিয়ে আসা দরকার। ওই সময়ের অনুভূতিগুলি লিখতে গিয়ে অনেক সময় চোখের কোণ ভিজে উঠেছে। মনের উপর চাপ পড়েছে ভীষণ। তবু লিখেছি নিজের সম্পূর্ণ আবেগ আর ভালোবাসা দিয়ে। ওই একটা ঘটনা ছাড়া, মোটামুটি রোমাঞ্চকর এবং আনন্দের ঘটনাই লেখাতে আনার চেষ্টা করেছি। লেখাগুলোতেও আছে ভিন্নতা। লেখাগুলোর অধিকাংশই ফেসবুকে দেয়ার জন্য লিখেছি। এই বইটা মূলত সেই লেখাগুলোর সংকলন। তাই পড়তে গিয়ে পাঠকের কাছে মাঝেমধ্যেই লেখার ধরণ ভিন্ন মনে হতে পারে। আগেই সেটি স্বীকার করে নিচ্ছি। এই বইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ফর্মড পুলিশ ইউনিটের ফিমেল কন্টিনজেন্ট কঙ্গোতে কী ধরনের কাজ করছে তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে। আশা করি বইটি পাঠকের ভালো লাগবে।