আমার বিভিন্ন সময়ে লেখা কিছু গল্পের সমন্বয়ে ‘বিপস্সনা’ নামের এই গল্পগ্রন্থের প্রকাশনা। ছোটবেলা থেকেই গুণীজনদের মূল্যবান লেখাগুলো পড়া এবং গুণী ভিক্ষুদের দেশনা শোনার একটা প্রবল আগ্রহ আমার মধ্যে গড়ে উঠেছিল। পাঠ্যাবস্থায় এবং চাকুরি-জীবনে ফরমায়েশি লেখা অনেক লিখেছি, কিন্তু ধারাবাহিকতা রক্ষা করে লেখালেখির চর্চায় প্রাণিত হবার সুযোগ বা চেষ্টা কখনো গ্রহণ করিনি। চাকুরি-জীবন পরিসমাপ্তির পর জীবন সম্পর্কে ভাবনাটা ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা সেই প্রবাহে অধিকতর গতি সঞ্চার করেছে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অনেক প্রাজ্ঞ বৌদ্ধ পণ্ডিত ভিক্ষুদের দেশনা এবং লেখার সাথে নিয়মিতভাবে সংযুক্ত থেকে নিজের মধ্যে বৌদ্ধিক চেতনাকে শাণিত করার তীব্র প্রেরণা জাগ্রত হতে থাকে। বিগত এক দশকেরও অধিককাল ধরে প্রতিদিন কোনো না কোনো বিশ্বখ্যাত ভিক্ষুর দেশনা শুনে কিংবা তাঁদের মূল্যবান রচনা পাঠ করে আমার সময় কেটেছে। সত্তরের দশক থেকে নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছিলাম বাঙ্গালী বৌদ্ধদের অহংকার দর্শনসাগর প্রিয়ানন্দ মহাথের মহোদয় এর। এরপর ২০০৭ সাল থেকে মাত্র কয়েক বছর নিবিড় সান্নিধ্য পেয়েছিলাম বৌদ্ধ পণ্ডিত ভদন্ত প্রজ্ঞাবংশ মহাথের মহোদয় এর। এই দুই গুণী ভিক্ষুর প্রত্যক্ষ প্রভাব এবং বিশ্বখ্যাত অনেক পণ্ডিত ভিক্ষুর পরোক্ষ প্রভাবে আমার ভাবনায় যে পরিবর্তন সুচিত হয়েছে-এই বইয়ের প্রায় সব গল্পে তার ছাপ রয়েছে। বাংলাদেশের এই দুই কীর্তিমান বৌদ্ধ ভিক্ষু যথাক্রমে দর্শনসাগর প্রিয়ানন্দ মহাথের এবং পণ্ডিত প্রজ্ঞাবংশ মহাথের সহ বিশ্বখ্যাত সকল ভিক্ষুদের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ঋণ আমি শ্রদ্ধাভরে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করছি। ‘বিপস্সনা’ নামে এই গল্পগ্রন্থ বিদর্শন ভাবনার দিক-নির্দেশনামূলক কোন লেখা নয়। তবে অধিকাংশ গল্পে ‘বিপস্সনা’র’ ছাপ রয়েছে। প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি ঘটনার যথাযথ পর্যবেক্ষণ, নিরীক্ষণ এবং শোধন করার নামই যদি বিপসসনা হয়ে থাকে তাহলে এখানে বর্ণিত অধিকাংশ গল্পে তা খুঁজে পাওয়া যাবে। নানান জনের লেখা পড়ে, দেশনা শুনে আমার মধ্যে যে অনুভূতির উন্মেষ ঘটেছে...অনেকটা তারই প্রতিফলন এই গল্পগুলো। কাজেই মৌলিক লেখা বলতে যা বুঝানো হয়... প্রায় সব লেখাই ঠিক সেই অর্থে মৌলিক নয়। যাঁরা নিয়মিত লিখেন, বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে... তাঁদের লেখাগুলো শতভাগ মৌলিক এমন দাবি করাটা কতটা সংগত আমি জানিনা। তবে আমি অকপটে স্বীকার করছি...আমার লেখাগুলো কোনভাবেই মৌলিকত্ব দাবি করেনা। বুদ্ধের শিক্ষা, বৌদ্ধ নীতি নৈতিকতা এবং বৌদ্ধ দর্শন নিয়ে অনেক কিছুই প্রতিনিয়ত ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন প্রকাশভঙ্গিতে বিভিন্ন লেখা বা বক্তৃতায় উপস্থাপন করা হচ্ছে। সেসব কোন ক্ষেত্রেই লেখক বা দেশকের মৌলিকত্ব দাবি করার সুযোগ বা অবকাশ নেই। দু’একটা লেখা সরাসরি অনুবাদ করে নিজে বুঝতে চেয়েছিলাম, সেগুলোও এখানে সংযোজন করে দিয়েছি। কিছু লেখা সম্পাদনার মাধ্যমে নিজের মতো করে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি ধর্মানুরাগী অনেকের কাজে লেগে যেতে পারে এই ভেবে। যে সব গুণী ভিক্ষুর লেখা নিয়ে এই দুঃসাহসিক কাজগুলো করেছি... সকৃতজ্ঞ চিত্তে তাঁদের কাছে বিনীতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। ছোট-বড় মোট আটাশটি গল্পের এই সম্ভারে বর্ণিত কাহিনিগুলো নিজেরাই নিজেদের পরিচয় তুলে ধরবে। তাই আলাদা করে তাদের বিবরণ তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করছি না। কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে বলে যাওয়া গল্পগুলো চিত্তকে স্থির রেখে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাঁরা পড়ে যাবেন...আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাঁরা নিরাশ হবেন না। করোনার কারণে দীর্ঘদিন বাধ্যতামূলক ঘরবন্দী জীবন যাপনের সুযোগে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গল্পগুলো পরিমার্জন করে গুছিয়ে নিতে গিয়ে এগুলো প্রকাশের চিন্তা মাথায় এল। আমার বড় মেয়ে অনন্যা বড়ুয়া এবং জামাতা শংকর বড়ুয়া পান্না তাদের অত্যধিক ব্যস্ততা সত্বেও বইটি ছাপানোর যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করে আমাকে নিশ্চিন্ত করেছে। বইটির প্রচ্ছদ পরিকল্পনা করেছে আমার ছোট মেয়ে লাবন্যা বড়ুয়া এবং জামাতা অমিত বড়ুয়া। আমার পুত্র সুদীপ্ত বড়ুয়া লেখাগুলো গুছানোর কাজে নানাবিধ কারিগরি সহায়তা দিয়ে আমাকে প্রতিনিয়ত সহযোগিতা দিয়েছে। আমি তাদের সবার সর্বাঙ্গীণ কুশল কামনা করছি। প্রচ্ছদ অলঙ্করণে এবং ছাপানোর কাজে যে সকল বন্ধুরা নিষ্ঠার সাথে কাজ করেছেন তাঁদের সবার জন্যে অফুরান শুভকামনা রইল। ত্রুটি বিহীন করার সর্বতো প্রয়াস সত্বেও শব্দবিন্যাস বা বানানে হয়তো ছোটখাটো কিছু ত্রুটি রয়ে যাবে। সেসব সহজভাবে নিয়ে সুধী পাঠকসমাজ যদি এই বইয়ে সন্নিবেশিত গল্পগুলো পড়ে কিছুটা হলেও উপকৃত হন... তাহলে ভালো লাগবে। একটি সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় সবার জন্যে নিরন্তর শুভ কামনা।