কোভিড পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থা হবে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা। মূলত প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা হবে অনলাইন আর অফলাইনের (শ্রেণিকক্ষে মুখোমুখি শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া) সংমিশ্রণে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন থেকে যায় প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় কি ধরনের কৌশল প্রয়োগ করা যেতে পারে, যা হবে পুরোমাত্রায় শিক্ষার্থীবান্ধব? এর সহজ প্রত্যুত্তর হতে পারে অভিজ্ঞতাভিত্তিক সহযোগিতামূলক শিখন কৌশল; যা বিশ্বব্যাপী সমানভাবে গ্রহণীয় এবং একইভাবে সমাদৃত এবং দেশের সদ্য সংযোজিত অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের অন্যতম অনুষঙ্গ। ‘সহযোগিতা’ মানব বিকাশের প্রাথমিক পাঠ। আদিমতার নাভীমূল থেকে অংকুরিত ‘সহযোগিতা’ আজ অবধি মানুষের এক প্রাত্যহিক মৌলিক চাহিদা; যা বয়ে চলা নদীর মতো বহু বাঁক ঘুরে ব্যক্তিক পর্যায় থেকে পরিবার, পরিবার থেকে গোত্র, গোত্র থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র কিংবা আরো বহুমূখী হয়েও বর্ধিষ্ণু তার আপন স্বভাবে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে অধুনা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার দীর্ঘ পথপরিক্রমায় সহযোগিতার বহুমাত্রিক সংক্ষিপ্ত রূপরেখা হলো এই গ্রন্থ নির্যাস। ‘সত্যিকারের জীবন প্রতিযোগিতার নয়, সত্যিকারের জীবন সহযোগিতার’ এই সত্যকে বুকে ধারণ করেই হয়তো প্রকৃতির আপন খেয়ালে আদি মানুষের বন্য জীবনের পরতে পরতে মিশে ছিল একে-অপরের প্রতি সহযোগিতার অলিখিত নিয়ম। মানব ইতিহাসের সেই আদিম সময়ে মানুষ একেবারে অসহায় অবস্থা থেকে কিঞ্চিৎ ঘুরে দাঁড়ায় পারস্পরিক সহযোগিতার পথ ধরে। সৃষ্টির আদি থেকেই মানুষের জীবনের শিখন প্রক্রিয়ার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে জীবন থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন। আদিম জীবনে মানুষের ক্ষুধা নিবারণের অন্যতম উপায় ছিল বন্য ফলমূল ও পশুপাখি শিকার। ফলমূল সংগ্রহ ও পশু শিকার করতে গিয়ে প্রায়শঃ তাদের হিংস্র পশুর আক্রমণে ক্ষত-বিক্ষত হতে হতো, কেউ আবার হয়তো মারা যেত। সেই সংকটময় বন্যজীবনে হাতিয়ার তৈরি ছিল তাদের কাছে এক মস্ত বড় আবিষ্কার। এ হাতিয়ার তৈরি ছিল সীমাহীন অসহায়ত্বের খানিকটা লাঘবে পারস্পরিক সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার এক অনবদ্য ফসল। এভাবে দশ হাজার বছর পেরিয়ে যাত্রা শুরু হলো পরিবার থেকে গোত্রকেন্দ্রিক একে-অপরের সহযোগিতায় পশুপালন এবং শস্য উৎপাদন কাল। শস্য উৎপাদন শুরু হলে মানুষ জীবিকার সন্ধানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে দলভেদে ছুটে বেড়াতে থাকে; যার আগাগোড়ায় মোড়ানো ছিল পারস্পরিক সহযোগিতা। এই আদিমতার গন্ধ মাখানো সহযোগিতার অন্যতম উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল নিজ-পরিবার কিংবা গোত্রের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সহজপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা, যার সুফল বংশানুক্রমে পরিব্যাপ্ত হতে থাকে। একটি সময়ে এসে ‘সহযোগিতা’ আর বৃত্তাবদ্ধ থাকেনি পরিবার, গোত্র কিংবা সমাজ পরিসরে। এর ব্যাপ্তির শিকড় মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান আর শিক্ষা চাহিদার গহীনে কৃমির মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে থাকে সহযোগিতার শেকড়। আধুনিক বুদ্ধিবিকাশের কালেও বিশ্বে সহযোগিতার শেকড় বহুমাত্রিক রূপ ধারণ করে বহুক্ষেত্রে সমভাবে প্রোথিত। এক্ষেত্রে, শিক্ষা অগ্রগণ্য। শিক্ষার বিকাশ মানে মানব সভ্যতার বিকাশ। সভ্যতার বিকাশে শিক্ষা হলো এক অনন্য প্রভাবক। শিক্ষা নামক প্রভাবক মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা, মনোবৃত্তি আর আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানব সত্ত্বাকে খণ্ড-খণ্ড প্রত্যয়ে বিশ্লেষণকরণে এক নান্দনিক বোধের জন্ম দেয়। তবে শিক্ষার প্রত্যেক বোধই শিল্পিত নয়। সব শিক্ষা থেকে সৌন্দর্যের জন্ম হয় না কিংবা বোধ মাত্রই শিক্ষা নান্দনিক হয়ে উঠে না। এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার মূল কারিগররূপী শিক্ষকের বিষয়গত গভীর জ্ঞান, অনুধাবন সক্ষমতা, স্বকীয় কল্পনা, ইন্দ্রিয়বোধ এবং শিখন-শেখানো কৌশল এই পঞ্চমুখী স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়ার সমীকরণ। এই সমীকরণের মূল আধার একজন শিক্ষক। তাই জ্ঞান অর্জন আর জ্ঞান বিতরণ এক বিষয় নয়। এক্ষেত্রে শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘‘পা থাকলেই হাঁটা যায় কিন্তু হাত থাকলেই লিখা যায় না’ এ অমীয় বাণী বেশ সমার্থক। শরৎ বাবুর বাণীর সাথে মিলিয়ে বলা যায় ডিগ্রী থাকলেই আজকাল হয়তো শিক্ষক হওয়া যায় কিন্তু শিখন-শেখানো ফলপ্রসূ করা যায় না। তাই শিক্ষক-প্রশিক্ষকের পেশাগত জীবনে জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান বিতরণ সমভাবে ক্রিয়াশীল। শিক্ষার্থীর কাছে শিখন-শেখানো তখনই কার্যকর হয় যখন শিক্ষক বা প্রশিক্ষক শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় নানা উপাদানে, প্রয়োগ-বৈচিত্র্যে, নানা কৌশলে জ্ঞান বিতরণ করে থাকেন, সেটা অনলাইন কিংবা অফলাইন যাই হউক না কেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে একে-অপরের প্রতি সহযোগিতামূলক শিখন মনোভাব পোষণ করানোর মূল কারিগর হলো একজন শিক্ষক বা সহায়ক। তাই অধুনা বিশ্বে শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় সহযোগিতামূলক শিখন কৌশল শিক্ষকতার প্রাণস্বরূপ। কোভিড পরবর্তীকালে এর প্রয়োগ হবে আরো অধিক। শিখন-শেখানো পরিমণ্ডলে এই অনস্বীকার্যতাকে গুরুত্ব দিয়ে কোভিড পরবর্তী বৈশ্বিক শিক্ষা ব্যবস্থায় অভিজ্ঞতাভিত্তিক সহযোগিতামূলক শিখন কৌশলের কোন বিকল্প নেই। সময়ের এই চাহিদা পূরণে ‘কোভিড পরবর্তী শিক্ষা ও শিখন কৌশল’ গ্রন্থখানা রচনার যাত্রাপথে আমরা দুজন সামিল হয়েছি। বাংলা ভাষায় শিখন-শেখানো পদ্ধতি ও কলাকৌশল সংবলিত আরো অনেক গ্রন্থ রয়েছে তা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই এবং এগুলোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বটে। তবে অভিজ্ঞতাভিত্তিক ‘সহযোগিতামূলক শিখন কৌশল’কে মূল প্রতিপাদ্য করে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ অঙ্গণে বাংলা ভাষায় রচিত এ রকম কোনো গ্রন্থ ইতোপূর্বে রচিত হয়েছে কিনা তা লেখক জ্ঞাত নয়। অভিজ্ঞতা অর্জনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা মানুষের সহজাত স্বভাব। অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন হলো অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখার প্রক্রিয়া; যেখানে পঞ্চ-ইন্দ্রিয়ের সমন্বিত ব্যবহারে সুনির্দিষ্ট প্রতিফলনে শিখন ঘটে। এই শিখন প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তি হচ্ছে কাজভিত্তিক বা হাতে কলমে বাস্তব অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন, যা অনেকগুলো শিখন প্রক্রিয়ার সমন্বয়। এর মধ্যে রয়েছে প্রকল্পভিত্তিক শিখন, সমস্যাভিত্তিক শিখন ও অনুসন্ধানভিত্তিক শিখন। এ সবগুলো শিখন প্রক্রিয়া অনুসরনের ক্ষেত্রে যে কৌশলটি শিখনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সেটি হলো সহযোগিতামূলক শিখন। একে-অপরকে সহযোগিতা করার মধ্য দিয়েই মানুষ নিরন্তর এগিয়ে যাচ্ছে। এই এগিয়ে যাওয়ার পথে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। জীবনব্যাপী শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়ায় শিখন হলো সেই মূল যা মানুষের আচরণের স্থায়ী রূপ। শিখন যথাযথকরণে বিবিধ কৌশল সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে, সহযোগিতামূলক শিখন সর্বাগ্রে। সহযোগিতামূলক শিখন একটি মাল্টিসেনসরি (বহুবিধ ইন্দ্রিয়স্থান) শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ শিখন-শেখানো কৌশল। যেখানে সকল শিক্ষার্থী সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ বিদ্যমান। সাধারণত এ প্রক্রিয়ায় দৃষ্টিনির্ভর, শ্রবণিক ও স্পর্শগ্রাহ্য এই ত্রিমাত্রিক উপায়ে শিখন শেখানো সকল তথ্যাবলি সকল ধরনের (বৈচিত্র্যময় শিশু ও ব্যক্তিসহ) অংশগ্রহণকারীর কাছে একইভাবে, একই সময়ে সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপন করা যায়। দলবদ্ধভাবে কাজে তথ্যাদি দৃষ্টিনির্ভরকরণে সংখ্যাবাচক চিত্র ও ছবির ব্যবহার, শ্রবণিকরণে আলোচনা ও পড়া এবং স্পর্শগ্রাহ্যকরণে লিখা তথা হাতের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যে কোন শিক্ষক-প্রশিক্ষক তাঁদের শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় বহুবিধ ইন্দ্রিয়স্থানভিত্তিক কৌশল প্রয়োগ করে সব ধরনের শিক্ষার্থীদের সমভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করতে পারেন। এক্ষেত্রে, কোভিড পরবর্তী শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় সহযোগিতামূলক শিখন কৌশল হতে পারে একটি পরীক্ষিত এবং সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য বিজ্ঞানসম্মত পন্থা। এক কথায় একে-অপরের সাথে মিলেমিশে শিক্ষা গ্রহণ করার নামই সহযোগিতামূলক শিখন। সহযোগিতামূলক শিখন প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কাউকে পরাজিত করা মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, বরং সকলকে এক সাথে নিয়ে জয়ী হওয়াই সহযোগিতামূলক শিখনের মূল উদ্দেশ্য। বিশ্বায়নের এই সময়েও অনেকে অভিজ্ঞতাভিত্তিক সহযোগিতামূলক শিখন কৌশল ধারণা, ধরন এবং উদ্দেশ্য বিষয়ে অনেক শিক্ষক-প্রশিক্ষক পুরোমাত্রায় অবগত নন। এছাড়া সহযোগিতামূলক শিখন কৌশল নির্বাচনেও সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। শিখন কৌশল নির্বাচনে সেশন সময়কাল, শ্রেণিকক্ষ পরিসর, শ্রেণিকক্ষ পরিবেশ, শিক্ষা উপকরণ ও এইড, শিখন-শেখানোর বিষয়বস্তু, শিক্ষার্থীর ধরন ও তাদের মেধার পর্যায় এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষকের দক্ষতা বিবেচ্য বিষয়। দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষক-প্রশিক্ষকগণ সুনিপুণভাবে সহযোগিতামূলক শিখন কৌশল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে শ্রেণিকক্ষে শিখন-শেখানো প্রক্রিয়াকে আনন্দঘন ও অর্থবহ করে তুলতে সক্ষম হন। সৃজনশীল চিন্তা চেতনার অধিকারী শিক্ষকগণ যদি সহযোগিতামূলক শিখনের ছড়ানো ছিটানো বিবিধ কৌশলগুলো একত্রে একটি গ্রন্থে গুচ্ছাকারে প্রাপ্তহন তাহলে শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় তাঁরা অধিকতর নিপুণতার পরিচয় দিতে সক্ষম হবেন এবং শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া হবে আরো প্রাণবন্ত। এ প্রেক্ষাপটে বহুদিনের শিক্ষকতা, প্রশিক্ষণ পরিচালনার অভিজ্ঞতা শিক্ষাঙ্গণ ও প্রশিক্ষণ পরিসরে সর্বাধিক সমাদৃত ও পরিচিত কৌশলসমূহ সহজ ভাষায় বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া লিপিবদ্ধকরণ, পাঠ-উপযোগীকরণ এবং পরিশেষে একত্রিতকরণের মধ্য দিয়ে সহযোগিতামূলক শিখন কৌশলকে মূল পুঁজি করে এবং নিজস্ব স্বকীয়তার সর্বোচ্চ মেলবন্ধন “কোভিড পরবর্তী শিক্ষা ও শিখন কৌশল” গ্রন্থখানা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। “কোভিড পরবর্তী শিক্ষা ও শিখন কৌশল” নামক বইখানায় সাতটি অধ্যায়ে নানাবিধ শিখন কৌশল লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে কোভিডকালীন বাস্তবতা ও জরুরি পরিস্থিতে শিক্ষা ধারণা, কোভিড পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থার স্বরূপ এবং অফলাইন, অনলাইন ও দূরশিক্ষণ ধারণা সম্পর্কে পাঠকদের অবহিত করা হয়েছে। ‘শিক্ষা ধারণার বিবর্তন: অভিজ্ঞতাভিত্তিক ও সহযোগিতামূলক শিখনের উদ্ভব নামক দ্বিতীয় অধ্যায়ে শিক্ষা ধারণার বিবর্তন, উত্তরাধুনিক যুগের শিক্ষা, অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন সূত্রপাত, বৈশিষ্ট্যাবলি ও উপযোগিতা, অভিজ্ঞতাভিত্তিক যোগ্যতা অর্জনে সহযোগিতামূলক শিখন, সহযোগিতামূলক শিখনের উদ্দেশ্য, সহযোগিতামূলক শিখনের নীতিমালা, সহযোগিতামূলক শিখনের প্রকারভেদ, একক শিখন, প্রতিযোগিতামূলক শিখন, সহযোগিতামূলক শিখন, সহযোগিতামূলক শিখনে করণীয়, সহযোগিতামূলক শিখনে দল গঠন নিয়মাবলী, সহযোগিতামূলক শিখন কৌশল প্রয়োগে বিবেচ্য বিষয়সমূহ, সহযোগিতামূলক শিখন দলের বৈশিষ্ট্যাবলি এবং সহযোগিতামূলক শিখন কৌশল প্রয়োগে আসন বিন্যাস ও সহযোগিতামূলক শিখনের মৌলিক কৌশলসমূহ কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে এ বিষয়ে অতি সহজ ও সরল ভাষায় সকল শ্রেণির পাঠক উপযোগী করে বর্ণনা করা হয়েছে। শ্রেণিকক্ষে সহযোগিতামূলক শিখন-শেখানো কৌশল অনুসরণের পাশাপাশি শিক্ষককে আরও অনেক কলা-কৌশল অনুসরণ করে শিক্ষার্থীদেরকে পাঠে আকৃষ্ট করতে হয়। সে জন্য সহযোগিতামূলক শিখন প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করার জন্য কিছু কৌশল অনুসরণ করা প্রয়োজন। তাই তৃতীয় অধ্যায়ে সহযোগিতামূলক শিখনে প্রস্তুত হওয়ার কলা-কৌশলগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন প্রাক অনুসন্ধান, ধাঁধাঁ, বিতর্ক, শূন্যস্থান পূরণ, খুঁজে বের করা, লেখা ও ছবির মিলকরণ, ছবির মর্ম অনুন্ধান, অন্যের সম্পর্কে বলা ইত্যাদি। অনেক সময় নতুন শ্রেণিতে উত্তীর্ণ কিংবা নতুন ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের পরস্পরের সাথে পরিচিতির প্রয়োজন হয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তা করেও থাকে (বিশেষত শ্রেণি শিক্ষকের উদ্যোগে)। তাই এখানে অভিজ্ঞতাভিত্তিক সহযোগিতামূলক শিখন-শেখানো কৌশলের অংশস্বরূপ ‘একে অন্যের সাথে পরিচিতি’ চতুর্থ অধ্যায়টি সংযোজন করা হলো। এছাড়া ‘একে অন্যের সাথে পরিচিতি’ অধ্যায়টি মূলত প্রশিক্ষণ পরিসরে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে, অধ্যায়টি প্রশিক্ষকদের বিশেষভাবে কাজে লাগবে। তাই অধ্যায়টিতে একে-অন্যকে জানা: কি এবং কেন প্রয়োজন, একে-অন্যকে জানার কৌশল: ধারণা ও প্রকার এবং কৌশলগুলো চারভাগে যথা এক. উপকরণভিত্তিক সহযোগিতামূলক কৌশলসমূহ, দুই. অঙ্গ সঞ্চালনভিত্তিক সহযোগিতামূলক কৌশলসমূহ, তিন. ইন্দ্রিয় প্রয়োগভিত্তিক সহযোগিতামূলক কৌশলসমূহ ও চার. ক্রিয়া সম্পাদনভিত্তিক সহযোগিতামূলক কৌশলসমূহ বিন্যস্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে। চারভাগে অন্তর্ভূক্ত প্রতিটি কৌশলের মূলভাব উদাহরণসহ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, পরবর্তী পঞ্চম ও ষষ্ঠ অধ্যায়গুলোতে একই ধারাবাহিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে পাঠকগণ সহজেই কৌশলগুলো আয়ত্ত করে শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করতে সক্ষম হন। সহযোগিতামূলক শিখন-শেখানো কৌশলগুলোর প্রয়োগ আরো আনন্দদায়ক, সৃজনশীল, প্রাণবন্তকরণ এবং শিক্ষার্থী-বান্ধবকরণে পঞ্চম অধ্যায়ে শিখনের ক্ষেত্রে জোড়া কৌশল ধারণা, জোড়া কৌশলের প্রয়োজনীয়তা, শ্রেণি শিখনে জোড়া কৌশলের সুবিধা ও সমস্যা, জোড়া শিখন কৌশলকে সার্থককরণে সহায়কের ভূমিকা এবং শেষ ধাপে শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ পরিসরে ব্যবহারযোগ্য জোড়া কৌশলগুলো পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করা হয়েছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে সূচনা কথন, দলীয় শিখন কৌশল: ধারণা ও গুরুত্ব, সহযোগিতামূলক শিখনে দলীয় কৌশলের বহুমাত্রিকতা, দলীয় কৌশলের সুবিধা, সহযোগিতামূলক দলীয় কৌশল প্রয়োগে সহায়কের ভূমিকা, দলীয় শিখন কৌশলে কাজের রূপরেখা সবিস্তারে বর্ণনাসহ যথারীতি পূর্ববর্তী অধ্যায়ের ন্যায় কৌশলগুলোকে উপকরণভিত্তিক দলীয় কৌশল, অঙ্গ সঞ্চালনভিত্তিক দলীয় কৌশল, ক্রিয়া সম্পাদনভিত্তিক দলীয় কৌশলে বিভাজন করে বর্ণনা করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, ষষ্ঠ অধ্যায়ে আগ্রহী পাঠকদের জন্য ইন্দ্রিয়ের প্রয়োগভিত্তিক ধারণা, শিখনে সংবেদনশীল ইন্দ্রিয়ের প্রয়োজনীয়তার দিকটি বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ধরিত্রীর ভবিষ্যৎমুখী শিক্ষা হবে ব্যক্তিগত, সামাজিক, পারিপার্শ্বিক, রাষ্ট্রীয় এবং বৈশ্বিক প্রে¶াপট বিবেচনায়। বৈশ্বিক সমস্যা সমাধান ও অনিশ্চিত পরিবর্তিত পরিস্থিতি, পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নেয়ার প্রবণতা, প্রাসঙ্গিক জ্ঞান-দ¶তা-দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন হবে ভবিষ্যৎমুখী শিক্ষার মৌলিক বিষয়। এগুলো নিশ্চিত করার প্রয়োজনে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শি¶াক্রমের কোন বিকল্প নেই। যে শিক্ষা মুখস্থমুখী, তথ্যমুখী কিংবা কেবলমাত্র ক্যাম্পাসমুখী সেই শিক্ষার কদর ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে এবং শিখন পদ্ধতিতে আসবে আমূল পরিবর্তন। আগামীর শিক্ষায় পরিবর্তন সাধিত হবে দুইভাবে এক. শিখনের পদ্ধতিগত ও শিখনের মূল্যায়নগত। শি¶া কার্যক্রমে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার দ্রুত গতিতে বাড়বে। গুগল স্প্রেডশিট ক্লাস রুম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, খোলা মাঠে শিক্ষাদান, দক্ষতাভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক শিক্ষা; যা মূলত হবে মিশ্র শিখন পদ্ধতিভিত্তিক। এই অধ্যায়ে আমরা ভবিষ্যৎমুখী শিক্ষায় শিখনের পদ্ধতিগত দিক থেকে যে ধরণের পরিবর্তন এবং তা সর্বত্র সমাদৃত হতে পারে যেমন: ব্যক্তিগত শিখন পন্থা, স্ব-নিয়ন্ত্রিত শিখন পন্থা এবং কানেক্টিভিজম শিখন পন্থা এ সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত ধারণা উক্ত অধ্যায়ে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। একই সাথে ভবিষ্যৎমুখী শিখন মূল্যায়নগত দিক থেকে শিক্ষা পরিসরে যা পর্যায়ক্রমে দৃশ্যমান হতে পারে তারও একটি ধারণা উক্ত অধ্যায়ে প্রদানের চেষ্টা করা হয়েছে। মূলতঃ শিখনের পদ্ধতিগত এবং শিখন মূল্যায়নগত আগামীর কল্পিত শিক্ষাচিত্র এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। ‘কোভিড পরবর্তী শিক্ষা ও শিখন কৌশল’ বইখানা কোন সুনির্দিষ্ট শ্রেণিকেন্দ্রিক নয় বরং তা কোভিডকালীন এবং কোভিড পরবর্তী সময়ে কি প্রক্রিয়ায় সহযোগিতামূলক কৌশলগুলো প্রয়োগ করা যেতে পারে সকল শ্রেণির শিক্ষার্থী এবং প্রশিক্ষণার্থীদের উপযোগী করে তাই ক্ষেত্র বিশেষে খেলার ছলে কৌশলগুলো বর্ণনা করা হয়েছে। তবে যে কোন শিক্ষক বা প্রশিক্ষক পাঠের বিষয়বস্তুর সাথে মিল রেখে প্রত্যেকটি খেলার বর্ণনাগুলোকে তাঁর নিজস্ব স্বকীয়তায় একটি পরিপূর্ণ সহযোগিতামূলক শিখন-শেখানো কৌশলে রূপান্তর করে শ্রেণিকক্ষে বা প্রশিক্ষণ কক্ষে প্রয়োগ করতে পারবেন। সহযোগিতামূলক শিখন-শেখানো কৌশলগুলো যে শুধু শিখন-শেখানো বিশেষত শিক্ষাঙ্গণ ও প্রশিক্ষণ পরিসরে ব্যবহৃত হয়ে থাকে তা কিন্তু নয়। বর্ণিত কৌশলগুলো গবেষণার উপকরণ হিসেবে, শিশু বিকাশে, পেশাগত জীবনে, যে কোন কর্মশালা, সভা, উঠান বৈঠক কিংবা পারিবারিক ও দৈনন্দিন জীবনেও সফলভাবে আনন্দঘন পরিবেশে প্রয়োগ করা যেতে পারে। কোভিড-১৯ পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এই জরুরি পরিস্থিতিতে শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় অনলাইন শি¶া প্লাটফর্ম হলো একটি অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ; যা শ্রেণিকক্ষভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিকল্প পন্থা। অনলাইন প্লাটফর্ম জরুরি পরিস্থিতিতে শিক্ষা ও শিখন প্রক্রিয়ায় এমন একটি পন্থা; যেখানে শিক্ষকবৃন্দ ভিডিও লেকচার শীট ও পিপিটি তৈরি করেন, যাতে শি¶ার্থীরা কোর্সের বিষয় একাধিকবার দেখতে বা বিশ্লেষণের সুযোগ পেয়ে থাকে। প্রযুক্তিচালিত বিশ্বে কীভাবে অনলাইন এবং শ্রেণিকক্ষ উভয় ¶েত্রে কোভিড পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থায় শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে, এ সম্পর্কে বইখানা’র প্রথম অধ্যায়ে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হয়েছে। প্রত্যেক অধ্যায়ের শুরুতে অধ্যায়ভূক্ত বিষয়সমূহের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করা হয়েছে। অন্তর্ভূক্ত শিখন কৌশলগুলো সরলরৈখিকভাবে বর্ণনা না করে কতগুলো মূল অংশে বিভাজন করে-এর অর্ন্তগত কৌশলগুলো বর্ণনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। কৌশল বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার শুরুতেই প্রতিটি সহযোগিতামূলক শিখন কৌশলের উদ্দেশ্য, উপকরণ, সময়, পদ্ধতিগত দিক ও প্রয়োগক্ষেত্র বিষয়ক আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া, প্রতিটি শিখন-শেখানো প্রক্রিয়ায় সকল ধরনের শিক্ষার্থীগণ (বৈচিত্র্যময় শিশু বা ব্যক্তিসহ) যাতে একইভাবে, একই সময়ে, একই কৌশলে সক্রিয় ও কার্যকরভাবে শ্রেণি কার্যে অংশগ্রহণ করতে পারে এ বিষয়গুলো বইখানা লেখার সময় বিশেষ বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। ‘কোভিড পরবর্তী শিক্ষা ও শিখন কৌশল’ গ্রন্থখানা প্রকাশে উৎসাহী হওয়ার পেছনে প্রণিধানযোগ্য কারণ ছিল, যথা এক. বাংলা ভাষায় অভিজ্ঞতাভিত্তিক যোগ্যতা অর্জনে সহযোগিতামূলক শিখন-শেখানো কৌশলকে আরো গতিশীল ও সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে কিঞ্চিত পরিমিত অবদান রাখার নিভৃত অভিপ্রায়, দুই. নবীন শিক্ষক ও প্রশিক্ষকদের হাতে একটা নতুন ভাবনা অর্পনের দায়বদ্ধতা, তিন. শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ পরিসরে এই ধরনের বইয়ের অপ্রতুলতা কমানোর কিছুটা যোগানকারীর ভূমিকা পালন। শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে লেখকদ্বয় সম্পৃক্ত থাকায় অধিকাংশ সময় সেশন পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়েছে যে, নবীন শিক্ষক বা প্রশিক্ষক এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রবীণ শিক্ষক ও প্রশিক্ষকগণেরও অভিজ্ঞতাভিত্তিক যোগ্যতা অর্জনে সহযোগিতামূলক শিখন সম্পর্কে ধারণা পর্যাপ্ত নেই। এ অভাববোধ প্রাথমিক পর্যায় হতে উচ্চতর পর্যায়েও অনুভূত হয়েছে। আমাদের মনে হয়েছে বাংলা ভাষায় এমন একটি গ্রন্থ থাকা উচিত, যা কোভিড পরবর্তী শিক্ষা ব্যবস্থায় সহযোগিতামূলক শিখন-শেখানো প্রক্রিয়াকে আরো সৃজনশীল, মননশীল, ধারাবাহিকতায় শিল্পময় এবং শিক্ষার্থীবান্ধব এবং সুখপাঠ্য করবে। এরূপ ভাবনা থেকেই আমরা দীর্ঘ ৪ বছরের অধিক সময় ধরে এ গ্রন্থটি রচনায় মগজের চিন্তা ও হস্তের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে আসছিলাম। গ্রন্থখানা শিক্ষক ও প্রশিক্ষককে যে কোন অধিবেশন আনন্দের সাথে কার্যকর করতে সর্বান্তকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।