অখণ্ড ভারতবর্ষে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের রাজনীতির চুড়ান্ত পরিণতি হলো ভারতবর্ষের বিভাজন। সেই ইতিহাসই বিধৃত হয়েছে ‘দ্বিখণ্ডিত রক্তাক্ত ভারতবর্ষ’ গ্রন্থটিতে। এখানে তুলে ধরা হয়েছে, ১৯১৬ সালে লখনৌ প্যাক্ট সম্পাদনের সূত্র ধরে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের জাতীয়তাবাদী ধারণা ধীরে ধীরে রূপ লাভ করে। আবার ধর্মের মিশ্রণ যে রাজনীতিতে ভয়াবহ, এর প্রমাণও ধীরে ধীরে পাওয়া যায়। হিন্দু-মুসলমান বিভেদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য তিনটি। প্রথমত, ভারতবর্ষে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সূচনা হয়েছিল ব্রিটিশদের যে নেপথ্য লক্ষ্য বাস্তবায়নে, তারই চুড়ান্ত রূপ হচ্ছে ভারতবর্ষের দ্বিখণ্ডিত রূপ। দ্বিতীয়ত, ভারতবর্ষের বিভাজনের ইতিহাস আমাদেরকে যে দার্শনিক বার্তা দেয় তা হলো, শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যদি বৈষম্যমূলক নীতি অবলম্বন করে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন, তাহলে কয়েক দশকের মধ্যে এর করুণ পরিণতি কী হতে পারে তারই নিখুঁত চিত্র উপস্থাপন করা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে রাজনীতি-বিশ্লেষকদের এই বার্তা পৌঁছে দেওয়াও। তৃতীয়ত, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা (অপরাজনীতি) যে মানবতাবিরোধী অপরাধ, সেই বার্তা পৌঁছে দেওয়া।
মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সম্পর্কেও বলা হয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের রাজনৈতিক তথা ভৌগোলিক সীমারেখা কী হবে অথবা অর্থনৈতিক কাঠামো কী হবে, সেগুলো সম্পর্কে মুসলিম লীগপন্থি রাজনৈতিক বা সাংবাদিক মহলে কোনো সুস্পষ্ট ধারণাই ছিল না। কেবল সুস্পষ্ট ধারণা ছিল, পাকিস্তানের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলামধর্ম। তাই স্বাভাবিকভাবে এ বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছিল এবং রাজনৈতিক বা সাংবাদিক মহলে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনাও হয়েছিল। এটা কি সাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ নয়?
১৯৪৬ সালের ১০ই জুলাই নেহেরুর প্রেস কনফারেন্সের ব্যাপারে একটাই কথা বলা যায় যে, নেহেরুর চল্লিশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে এটাই সবচেয়ে জ্বালাময়ী বিবৃতি। যেখানে আছে রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠার অপরাজনীতি। অন্যদিকে এই বিবৃতি এবং সরদার প্যাটেলের হিন্দুত্ববাদের দাবিই জিন্নাহকে স্বতন্ত্র ইসলামি রাষ্ট্র ‘পাকিস্তান’ প্রতিষ্ঠার দাবি তুলতে বাধ্য করেছিল। আর পরবর্তীকালে অসাম্প্রদায়িক দল কংগ্রেসও পালটা সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে। এই বিরোধ প্রকাশ্যে না এলে প্রকৃত অর্থে ভারতবর্ষ বিভক্ত হতোই না।
আর উল্লিখিত বক্তব্যই তুলে ধরা হয়েছে ‘দ্বিখণ্ডিত রক্তাক্ত ভারতবর্ষ’ গ্রন্থটিতে - শক্তিশালী অনুলিখন ও সম্পাদনার মাধ্যমে অত্যন্ত সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় এর দার্শনিক দিকটি। পাঠককুলের মূল্যবান অভিমত পেলে ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরো ক্লাসিক সিরিজ গ্রন্থ প্রকাশ করা হবে।