ভূমিকা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেশভূষা, বিলাস-বৈভবে মানুষ আজ সভ্যতা-ভদ্রতার স্বর্ণ শিখরে উঠে গেলেও শান্তি নামক সোনার হরিণ যেন নাগালের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। শান্তি আসবে কী করে? নর-নারীর মধ্যকার বৈষম্যের কাদায় বিশ্বজুড়ে জল এত ঘোলা হয়ে গেল যে, তা জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগিয়ে তুলছে জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। এ জল ঘোলাকারীটা কে? নর না নারী? এমন প্রশ্ন উঠলে চারদিক থেকে সবার আঙুল নারীর দিকেই উঠবে। ওঠাটা অস্বাভাবিকও নয়। কারণ অবহেলা সইতে না পেরে নারীই তো আন্দোলনের কড় তুলছে, পুরুষের হাতের শেকল থেকে মুক্তি পেতে জোরাজুরি করছে, মুক্ত বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। এত হট্টগোলের মধ্যে জল কীভাবে স্থির থাকে আর কীভাবেই বা পরিবেশ শান্তিময় থাকে? প্রশ্ন হলো, যে নারীর শান্তি নিশ্চিত করার কথা ছিল সে নারীই আজ শান্তি ভঙ্গের কারণ হয়ে দাঁড়ালো কেন? সে কেন নারী-পুরুষের ব্যবধান ঘুচিয়ে সবকিছুতে সমান অধিকার পাওয়ার দাবি তুলে আন্দোলনে নেমেছে? তার এ দাবি কতটা যুক্তিযুক্ত? সমাজ নিয়ন্ত্রিত হয় যে দিক-নির্দেশনায় সেখান থেকেই বা তার দাবিগুলো কতটা সমর্থন লাভের যোগ্যতা রাখে? এমনি নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তার মৌলিক কিছু দাবি, দাবির যৌক্তিকতা এবং তা পূরণে যথার্থ সমর্থন লাভের উপায় নিয়ে জানার চেষ্টা করি। মজার ব্যাপার, এসময় নর-নারীর সৃষ্টি এবং সৃষ্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে আদপেই কোনো বৈষম্য আছে কিনা তা জানতে খুব ইচ্ছে হলো। তো সেখান থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে শিক্ষা, উপার্জন, ধর্ম, পরিবার, সমাজ প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারীর অধিকার সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করি। একবার একথাও মনে আসে ভব্যতার গণ্ডিতে পা রাখার আগে অর্থাৎ আদি থেকেই কি নারীর উপর পুরুষের এমন দমন পীড়ন চলে আসছে? এর উত্তর জানতে গবেষণালব্ধ ও ধর্মীয় ইতিহাসের দ্বারস্থ হই। অবাক হয়ে যাই, যখন দেখি প্রাগৈতিহাসিক যুগে নারীকেই পুরুষ সকল ক্ষমতার উৎস মনে করে পূজা করত যার প্রচলন এখনও হিন্দু সম্প্রদায়ে লক্ষ্য করা যায়। অন্যান্য সম্প্রদায় যদিও নারীকে পূজার আসনে বসিয়ে রাখে নি তাই বলে তাকে পুরুষের হাতের পুতুল বানানোর ব্যবস্থাও করে দেয় নি। বরং ধর্মভেদে কমবেশি নারীকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছে, দিয়েছে নানাবিধ অধিকার। কিন্তু হায়! মানুষ যেন সেই মর্যাদা আর অধিকারকে ধর্মীয় পুস্তকের শ্রীবৃদ্ধির জন্য যত্নে তুলে রেখেছে তা খরচ করার সাহসও করে না! কিন্তু ভুললে চলবে না নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসলে যেমন তা বহুগুণে বেড়ে যায় তেমনি অন্যকে যথাযোগ্য মর্যাদা আর অধিকার দিলে পক্ষান্তরে তা নিজেরই মর্যাদা আর অধিকার বাড়িয়ে দেয়। আর নারীর এ প্রাপ্য তো বুঝিয়ে দিতেই হবে, তা না হলে নারীর অমূল্য দান গ্রহণ করা পুরুষের জন্য অবৈধ বলে গণ্য হবে। পুরুষ-নারীর দান গ্রহণ করে?? হ্যাঁ, অবশ্যই করে। আর তা নির্দ্বিধায় স্বীকার করেই পুরুষ-সমাজের বিবেকবান প্রতিনিধি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন- 'আমরা পুরুষরা বড়োজোর আমাদের শক্তিকে দিতে পারি, মেয়েরা যে আপনাকে দেয়। ওরা আপনার প্রাণের ভিতর থেকে সন্তানকে জন্ম দেয়, পালন করে, বাহির থেকে নয়। এই দানই তো সত্য দান।' –(ঘরে-বাইরে) কিন্তু তারপরও নারীর প্রতি এত অবহেলা?