ইতিহাস কথা বলে দীর্ঘ পথ পরিক্রমার। যে পথ কখনও বন্ধুর, কখনও তিক্ততা, কখনও ব্যর্থতার, কখনও অর্জনের, কখনও বা গৌরবের। বাংলার ইতিহাস বা বাঙালির ইতিহাস তেমনি। হাজার বছরের বাঙালির পথচলা সবসময় কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। আর আমাদের নিকট অতীতে অন্তত পাঁচশত বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখি মুঘল, পাঠান, পাল, সেন, নবাব, বৃটিশ বেনিয়া এবং সবশেষ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দু’টি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন এবং নতুন নতুন রাজনৈতিক সংকটের সূচনা। ইতিহাস বলে যে কোনও সংঘাত আর সংকট থেকেই আরও নতুনের যাত্রা। দেশভাগ হলো ঠিকই কিন্তু একের পর এক আঘাত আসতে লাগলো পূর্ববঙ্গের মানুষদের ওপর। প্রথমেই আসে মায়ের মুখের ভাষা কেড়ে নেয়ার পাকিস্তানি শাসকদের চাপিয়ে দেয়া অন্যায়। বাঙালি মাথা নত করেনি। রুখে দাঁড়িয়েছে। মায়ের ভাষা মাতৃভাষার জন্য রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করেছে। পাকিস্তানিরা তখনই বুঝে গেছে, এরা মাথা নোয়াবার নয়। বাঙালি প্রতিবাদ করতে জানে। তখন থেকেই সূচনা। আজকের যে বাংলাদেশ তার বীজ বপন সেই উত্তাল সময় থেকেই। তারপর তা বীজ থেকে মহীরুহ। একাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াই এবং ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীনতার প্রদীপ্ত লাল সূর্যের জয়যাত্রা। এমন ঘটনাপ্রবাহ আজ আমাদের ইতিহাসের স্বর্ণালি অধ্যায়। আর তা যদি হয় প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে। বলছিলাম, নূরে আলম সিদ্দিকীর কথা। যিনি বাংলাদেশ সৃষ্টির ঘটনা প্রবাহের অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী। যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর। যাকে বলা হয়ে থাকে বঙ্গবন্ধুর চার খলিফার একজন। উত্তাল স্বাধীনতা আন্দোলনের দিনগুলোতে যিনি মাঠ দাবড়ে বেড়িয়েছেন। অকুতোভয় লাখো তরুণ প্রাণকে উজ্জীবিত করেছেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। তিনি এখনও সরব, উচ্চকিত দেশের চলমান সমস্যা ও সংকটে। করোনা অতিমারিতে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি কোনদিকে ধাবমান, রাজনীতিতে ঘূর্ণায়মান সংকটের সুরাহা আদৌ সম্ভব কি? এমন চলমান নানা ইস্যু নিয়ে তিনি লিখেছেন প্রায় বিশটির মতো মতামতধর্মী বিশ্লেষণ। যেখানে উঠে এসেছে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণে করণীয়। আশা করি, নতুন প্রজন্ম প্রকাশিত এ বই থেকে আগামী দিনগুলোতে পথ চলায় একটি রূপরেখা পাবেন।
তিনি বিগত শতাব্দীর ষাট দশকের এক অনবদ্য সংগ্রামী পুরুষ। ঐ দশকের অগ্নিঝরা দিনগুলিতে ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী তুর্কি তাজির মতো ক্ষুরের দাপটে মেদিনী কাঁপিয়েছেন। জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান, দৈনিক ইত্তেফাকের কালজয়ী সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের স্নেহাস্পর্শে গণতন্ত্র, অসম্প্রদায়িকতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক চেতনায় বেড়ে উঠেছেন তিনি। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক মতাদর্শ তাঁর রাজনৈতিক জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। ছয় দফা আন্দোলনের প্রথম শহীদ মনু মিয়ার রক্তাক্ত জামা নিয়ে ’৬৬-এর ৭ জুন ঢাকায় আইউববিরোধী মিছিলের নেতৃত্বদানের মধ্য দিয়ে এ দেশের রাজনীতিতে একজন বলিষ্ঠ ও সুযোগ্য ছাত্রনেতা হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৭০-এর নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র রুখে দেওয়ার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের তদানীন্তন সভাপতি হিসেবে তিনি যে সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার স্বাক্ষর রেখেছেন, তা এদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বলতম অধ্যায় হয়ে রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৭১-এর ১ মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার মুহূর্ত থেকে স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তরকালে স্বাধীনবাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সব সভায় সভাপতিত্ব করার একক গৌরব তাঁর। ২৩ মার্চ ১৯৭১-এ প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলনের সময় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃ চতুষ্টয় আনুষ্ঠানিক অভিবাদন গ্রহণ করার পর সেই পতাকাটি তিনি সগৌরবে বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন। তিনি আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গবন্ধুর অন্যতম বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে আজও তিনি বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ-ত্যাগ এবং নেতৃত্বের বিশ্বস্ত অনুসারী হিসেবে নিজেকে অবিচল অবস্থানে ধরে রেখেছেন। দেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আজ যে কক্ষচ্যুতি, পথভ্রষ্টতা, স্বার্থমগ্নতা এবং নিজ হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার দূষিত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, নূরে আলম সিদ্দিকী তাতে বিচলিতবোধ করেন। বৃহত্তর যশোরের ঝিনাইদহে ১৯৪৪-এর ২৬ মে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নূরনবী সিদ্দিকী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মানিক মিয়ার ঘনিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন। ১৯৬৬-এর জুনে ছয় দফার পক্ষে আয়োজিত হরতালে বলিষ্ঠ নেতৃত্বদানের অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তার হন। অতঃপর ১৭ মাস কারান্তরালে থাকাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেন এবং ঐ বন্দিদশায়ই তিনি স্নেহময়ী জননী নূরুন নাহার সিদ্দিকীকে হারান। কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে থাকা অবস্থায় তিনি বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসশাস্ত্রে ট্রিপল এমএ ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৭০ সালে আইনশাস্ত্রেও উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণের পর সামরিক বাহিনীর হাতে বন্দি অবস্থায় নির্যাতন, লাঞ্ছনা ও শত অপমানে জর্জরিত হয়েছেন; প্রতিনিয়ত মৃত্যুর প্রহর গুনতে হয়েছে তাঁকে। বর্তমানে তিনি ডরিন গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি সাবেক সাংসদ এবং প্রাক্তন ছাত্রলীগ ফাউন্ডেশনের আহ্বায়কও। প্রকাশিত গ্রন্থ ৫টি : ‘একাত্তরের অজানা কাহিনী: এক খলিফার বয়ান’, ‘আওয়ামী লীগ বিরোধী নই, তবুও সমালোচনা করি’, ‘কালের কলধ্বনি’, ‘সংঘাত সংশয় সাফল্য’ ও ‘ইতিহাস একদিন কথা বলবেই’।