প্রায় সবাই কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নেন, সব বইতেই ভূমিকা থাকে। দেশের স্বনামধন্য, প্রতিষ্ঠিত, পরিচিত জনেরা ভূমিকা লিখেন। কত বড় মাফের মানুষ দিয়ে ভূমিকা লেখানো হলো তার একটি প্রতিযোগিতাও চলে। বইমেলা এলে এসব টের পাওয়া যায়। অনেক খ্যাতিমান মানুষ বইমেলার আগে ইশারা-ঈঙ্গিতে বলে থাকেন, তার হাতে কতগুলো বইয়ের ভূমিকা লেখার কাজ জমে আছে। আমার আরো দু’টি বই আগে বাজারে এসেছে, সে বই দু’টির ভূমিকা লেখা হয়েছে। ভালো লিখিয়ে দু’জন মানুষ ভূমিকা লিখে দিয়েছেন, তাদের কাছে বইয়ের পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে ভূমিকা লিখে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলাম। এবারের বই ‘খবরের ভেতরে খবর’ এর কোনো ভূমিকা কাউকে দিয়ে লেখাতে চাই না, দু’টি কারণে। এক. আমি বড় কোন লেখক নই যে আমার বইয়ের ভূমিকা লেখতে হবে। দুই. বইয়ে যা লিখেছি-তার সঙ্গে আমি নিজে জড়িত। যাকে দিয়ে ভূমিকা লেখাবো তিনি ঘটনাগুলো আমার মত করে অনুভব করবেন সেটা মনে করতে পারি না। প্রায় সাড়ে তিন দশক সংবাদকর্মীর জীবনে বেশ কিছু ঘটনা কাছে থেকে, ভেতরে থেকে দেখেছি। একজন সংবাদকর্মী যা দেখে, তার সবটুকু সংবাদ নয়। সবটুকু পত্রিকায় প্রকাশযোগ্যও নয়। দেখার মাঝেও কিছু থেকে যায় অলেখা, পাঠকের কাছে সেগুলো হয়ে থাকে অদেখা-অজানা। একবার একটি লেখার শিরোনাম করেছিলাম ‘যারা সংবাদ লেখেন তাদের খবর ক’জন রাখেন।’ একজন সাংবাদিক সবার কথা লিখলেও তার নিজের কথা লেখার জায়গা নেই। ‘খবরের ভেতরে খবর’ বইটি অনেকটা সে ধরনের। এক সময়ে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থী রাজনীতির খুনোখুনি নিয়ে সিরিজ রিপোর্ট করেছি। কখনো কখনো চরমপন্থীদের রোষানলে পড়েছি। তাদের ডেরায় ধরে নিয়ে গেছে, মারতে গিয়েও আবার মারেনি, ছেড়ে দিয়েছে। সন্ত্রাসী-গডফাদারের বিরুদ্ধে নিউজ করে জীবনকে হুমকির মুখে ফেলেছি। খুন করার জন্য মাস্তান ভাড়া করে অস্ত্র হাতে তুলে দিয়ে পাঠিয়েছে ভাড়াটে খুনি রাতের আঁধারে দেখা করে খুন করার বদলে অনুরোধ করে গেছে ওমুক ভাইর সঙ্গে বিরোধটা মিটিয়ে ফেলুন, না হলে খুন হয়ে যাবেন। একটি চরমপন্থী সংগঠন আমার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। তাদের পার্টি রেজুলেশনে লিখেছে ‘আমাকে দৈহিকভাবে উচ্ছেদ করা হবে।’ ফোন করে আমাকে সেটা শুনানো হয়েছে। জবাবে শুধু বলেছি ‘বাহ দৈহিকভাবে উচ্ছেদ করা শব্দটি কিন্তু দারুণ লাগলো। সে পার্টির নেতা এখনো বেঁচে আছে, তার সঙ্গে মাঝে মাঝে কথাও হয়। মৃত্যুদণ্ড নিয়ে কোনো কথা তুলি না, উনিও বলেন না। সিরাজগঞ্জের যমুনা চরের শুকুর আলীকে আমি দেবতার আসনেই রাখি। গাজাঁ বিক্রি করে বাচ্চাদের জন্য স্কুল চালায়। তার গাজা বিক্রির রিপোর্ট পত্রিকায় লিখিনি। সর্বহারা রাজনীতির তুখোড় মানুষ সিরাজ শিকদারকে কারা ধরিয়ে দিলো, কে তাকে চিনিয়ে দিলো সিরাজ শিকদারের নির্দেশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হুমায়ূন কবীরকে হত্যা করা হয় সে হত্যার দায় পড়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের ওপর। ভঙ্গুর-ছিন্ন-ভিন্ন সর্বহারা পার্টির একাধিক গ্র“পের সঙ্গে দিনের পর দিন লেগে থেকেছি সেই সব নেপথ্য ঘটনাগুলো বের করতে। পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের বেদের মেয়ে নাটকটি যে কাল্পনিক নয়, সত্য ঘটনা নিয়ে রচিত সেটা খুঁজে বের করেছি। ফরিদপুরের সাংবাদিক গৌতম দাসকে কারা খুন করলো, সে তথ্য বের করতে অনেক পথ ঘুরেছি। এককালের দুর্ধর্ষ চরমপন্থী নেতা সামাদ মেম্বার ফোনে বলেছিল ‘শালা সাংবাদিক মানে বেঈমান।’ মাদারীপুরে দু’জন পুলিশ কর্মকর্তাকে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়েছিল চরমপন্থীরা। তাবলীগ জামায়াতের লোক সেজে সে ঘটনার নেপথ্য ঘাতকের বের করেছিলাম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেদিন বাড়িতে আসেন সেদিন ছিলাম তার সাথে। যা তিনি বলেছিলেন, বাল্যবন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছিলেন সে সব কথা পত্রিকা লেখা যায়নি। এ সব নিয়ে ‘খবরের ভেতরে খবর’। কেউ পড়বে কি না জানি না তবে অনেক ঘটনাই মিলে যেতে পারে আপনার জীবনের সঙ্গে।