আমার জবাবদিহিতা একজন কবি আছেন, প্রত্যেক বছর সাহিত্যে যার নোবেল পাওয়ার কথা থাকে, কিন্তু কখনও পান না। তাকে আপনারা অ্যাডোনিস নামে চিনে থাকবেন। আরব বিশ্বের প্রধান জীবিত কবি আলী আহমদ সাঈদ ইসবার ওরফে অ্যাডোনিস। অ্যাডোনিস একবার বলেছিলেন, পৃথিবী যদি কোনো ফুল হয়, তবে কবিতা হচ্ছে তার সৌরভ। এই বিচারে ২২ জানুয়ারির পর থেকে কবিতা মূলত সৌরভহীন। ২২ শ্রাবণ ও ২২ অক্টোবরের পর ২২ জানুয়ারিকেও কবির মৃত্যু উদযাপনের এক ধ্রুপদী তারিখ ঘোষণা করে সেদিন স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নেয় কবি সৌরভ মাহমুদ্। আপনারা যারা বিপন্ন পুষ্পের প্রলাপ বইটি হাতে করে এই লেখাটা এখন পড়ছেন, খুব সম্ভবত আপনারা আমার আগের তিনটা কাব্যগ্রন্থও পড়েছেন। অভিজ্ঞতা থেকে জানি, আমার বইয়ের সিংহভাগ পাঠকই আগের বইয়ের কবিতার ধারাবাহিকতার খোঁজে নতুন বই সংগ্রহ করে। কিংবা এটাই যদি হয় আপনার সংগ্রহে থাকা আমার একমাত্র বই, সেক্ষেত্রে আগের বইগুলো পড়বার তেমন একটা সুযোগ আপনার আর নেই। বইগুলো আর পাওয়া যায়না, আপাতত পুনর্মুদ্রণও করা হবে না সেগুলো। কেন হবেনা সে প্রসঙ্গে অন্য কখনো বলবো। তবে এ আলাপ আপনি আমার নতুন পাঠক নাকি পুরাতন, সে প্রসঙ্গে নয়। মূল প্রসঙ্গ হচ্ছে সৌরভ মাহমুদ্ আর নেই। আমার আগের তিনটা বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করার পূর্বে সৌরভ মাহমুদে্র সাথে বসে কবিতা নির্বাচন করতাম আমরা। সৌরভ আর নেই, নেই আমার লেখার সবচেয়ে নিষ্ঠুর সমালোচক, নির্বাচক। এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি সৌরভ দেখে যেতে পারেনি, সেদিন বিকেল পাঁচটায় পাণ্ডুলিপি নিয়ে আমার সাথে বসার কথা সৌরভের, সাড়ে চারটায় সৌরভ ঝুলে পড়ে নিজের প্রিয় মাফলারে। এই পাণ্ডুলিপি তাই কিছুটা এলোমেলো, অধারাবাহিক, বিক্ষিপ্ত ও সৌরভহীন। অবশ্য পুরো দায় কেবল সৌরভের চলে যাওয়ার ওপর ফেলতে পারছি না। যতই কবি হই, আমারও তো একটা ব্যক্তিগত পাকস্থলি আছে, এই কবি মগজটা শেষ পর্যন্ত সেই পাকস্থলিতেই পোষা লাগে। গত একটা বছর চলে গেছে পাকস্থলির খেয়াল রাখতে। দিন শেষে কবিতা তো আসলে একটা ধ্যান, নিজের সাথে নিজের বলা কথা, গত একটা বছর নিজের সাথে খুব বেশি কথা বলতে পারিনি আমি, লেখা হয়নি খুব বেশি কবিতাও। তবে এ বইয়ে যেকটা কবিতা আছে, তার সবই ধ্যানেরই ফসল। পাঠকদের সাথে তো মিথ্যে কথা বলাই যায়, কিন্তু কবিতা যেহেতু নিজের সাথে বলা নিজের কথা, নিজের সাথে তাই বেঈমানি করিনি। আমি সম্ভবত আরও কিছুকাল, হয়তো আরও বহুকাল পাকস্থলির যত্ন নিতেই ব্যস্ত থাকবো। কবিদের এই কাফেলা থেকে আপাতত যাত্রাবিরতি নিচ্ছি। তবে প্রস্থান নয়। সেই সুদীর্ঘকালের বিরতিতে এই বইয়ের কবিতাগুলোই আপনাদের কাছে রেখে যাওয়া আমার ধ্যানের শেষ আমানত। এ আমানত দেখেশুনে রাখবেন। আমি যেন হারিয়ে না যাই।