যুদ্ধ একাকীজনকে জনসমুদ্রে একত্রীভূত করে আবার জনস্রোতে ভেসে চলা জীবনও যুদ্ধের বাস্তবতায় হয়ে উঠতে পারে নিরবলম্ব। লড়াই যেন আধুনিক ব্যক্তি-আত্মার এক অমোঘ নিয়তি। প্রাবন্ধিক-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরী এই সংগ্রামী ব্যক্তিমনকেই ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষণবিন্দু থেকে দেখতে চেয়েছেন জনান্তিকের মুক্তিযুদ্ধ গ্রন্থে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা দেশভাগ, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে রবীন্দ্র-উত্তর সাহিত্যচর্চা, বাঙালি নারীর মুক্তিসাধনা ও নারীর ব্যক্তিচৈতন্যের মনোময় দর্শন, রাজনীতি—সেই সূত্রে নজরুল; এ রকম বিচিত্র স্বাদের প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে এই গ্রন্থে। এতে জীবনের নানা-প্রান্তিক নিরীক্ষণের শৈল্পিক কোলাজ তৈরিতে আগ্রহী হয়েছেন ভীষ্মদেব। আবার এই হরেক স্বাদের কোলাজকে লেখক নিজের গভীরতা-সঞ্চারী মননে বেঁধে রাখেন যুদ্ধ-প্রতিমার নান্দনিক বাঁধনে। পাঠকদের বুঝিয়ে দেন, প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের বাইরেও অবিরত যুদ্ধ চলে; রবীন্দ্র-গল্পের চরিত্রদল, নটবর, অপু, নিতাই-বসন্ত কিংবা একান্ত বাস্তবের বাঙালি নারী হরিপ্রভা সকলেই যেন ওই লড়াইয়ের সৈনিক। প্রশ্ন জাগে; তবে কি এই যুদ্ধের উত্তাপ গ্রন্থকারকেও ছুঁয়ে থাকে? তাঁকেও শামিল করে জনতার কিংবা জনান্তিকের যুদ্ধে? গ্রন্থে ছড়িয়ে থাকা এ রকম নানাবিধ নান্দনিক জিজ্ঞাসা, গ্রন্থকারের বিশ্লেষণধর্মী ভাষাভঙ্গি আর গহিন চিন্তাশৃঙ্খল সাহিত্যপ্রেমী পাঠক ও সাহিত্য-গবেষকের মনে নতুনতর ভাবনা জাগিয়ে তুলবে নিঃসন্দেহে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম সিলেট শহরে। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি উপাধি লাভ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। দীর্ঘ ঊনত্রিশ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে যুক্ত আছেন এই পেশায়। ২০০০ সনে তিনি বৃত হন প্রফেসর পদে। পাঠদান, সাহিত্য বিবেচনা ও গবেষণা তাঁর চিন্তা, আনন্দ ও উদ্যমের উৎস। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়।