আমি আশা করি পাঠকগণ স্মরণ রাখবেন, এই গ্রন্থটি আমার জীবনের এক বিশেষ দুঃখপূর্ণ সময়ে লেখা। এর মধ্যে তার ছাপ বিদ্যমান। যদি অধিকতর স্বাভাবিক অবস্থায় লিখতে পারতাম, তা হলে এটি হয়তো স্বতন্ত্র রকমের হত এবং সম্ভবত স্থানে স্থানে অধিকতর সংযত হত। তবুও আমি বর্তমান আকারেই এটি প্রকাশের সংকল্প করলাম, কেননা লেখার সময় আমার মনে যে সব ভাবের উদয় হয়েছে, কেউ কেউ তা পাঠ করে তৃপ্ত হতে পারেন। আমার নিজের মানসিক বিকাশ ও পরিণতিকে অনুসরণ করতে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, ভারতের আধুনিক ইতিহাস লিখতে চেষ্টা করিনি। এই বর্ণনার মধ্যে ঐরকম বাহ্য সাদৃশ্য রয়েছে বলে কোনো কোনো পাঠক বিভ্রান্ত হতে পারেন এবং এর যা প্রাপ্য নয় তার বেশি গুরুত্ব আরোপ করতে পারেন। অতএব আমি তাঁদের সাবধান করে দিয়ে বলতে চাই, এই বর্ণনা সম্পূর্ণভাবে একদেশদর্শী এবং অনিবার্যভাবেই এতে আত্মকীর্তন এসে পড়েছে, এতে অনেক গুরুতর ঘটনার একেবারেই উল্লেখ করিনি; অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি যাঁরা ঘটনার স্রোত নিয়ন্ত্রিত করেছেন, তাঁদের কথা অল্পই বলেছি। অতীত ঘটনার প্রকৃত আলোচনায় এটি অমার্জনীয় হতে পারে কিন্তু ব্যক্তিগত বিবৃতিতে এ প্রশ্রয়টুকু পাবার আশা রাখি। যাঁরা আমাদের আধুনিক অতীত সম্পর্কে প্রকৃতভাবে অধ্যয়ন করতে চান, তাঁদেরকে অন্যত্র অনুসন্ধান করতে হবে। যাহোক, এই গ্রন্থ ও অন্যান্য আত্মজীবনী তাঁরা পরিপূরক হিসেবে পাঠ করতে পারেন এবং এটি বাস্তব ঘটনা বোঝার পক্ষে সহায়ক গবে বলে মনে করি।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ও স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর ব্যারিস্টারি পেশা ছাড়াও আরেকটি পরিচয় আছে। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশই নয়, বিশ্বপাঠকের কাছে তিনি একজন সমৃদ্ধ লেখক। পণ্ডিত নেহরু এলাহাবাদে জন্মগ্রহণ করেন, ১৮৮৯ সালের ১৪ই নভেম্বর। পনেরো বছরের কিশোর নেহরু বিলেতে পাড়ি জমান, প্রাথমিক শিক্ষার পরের পাটটা বিলেতেই সম্পন্ন হয়। বিলেতে তিনি পড়াশোনা করেছেন হ্যারো ও কেম্ব্রিজে। পড়াশোনা শেষ করার পর পেশা হিসেবে বেছে নেন ব্যারিস্টারিকে। তিনি দেশে ফেরেন ১৯১২ সালে। ফেরার পরই সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, সেসময় বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছে। অনেকদিন বিদেশে থাকার ফলে অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্প তাঁকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করে এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সফলতার মুখ দেখবার জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে পড়েন। অসহযোগ আন্দোলনের সময়টাতে দু’বার কারাবরণও করেন নেহরু। মহাত্মা গান্ধী দ্বারা তিনি বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। জওহরলাল নেহরু এর বই সমগ্র পড়লে তাঁর ব্যক্তিজীবনের দর্শন, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অনেকটাই জানতে পারা যায়। কন্যা ইন্দিরা গান্ধীর ছোটবেলায় তাঁর কাছে কিছু চিঠি লিখেছিলেন নেহরু। সে চিঠিগুলো পরে বই আকারে প্রকাশ পায়, ‘লেটারস ফ্রম অ্যা ফাদার টু হিজ ডটার’ নামে; যা পরবর্তীতে বাংলা ভাষায় ‘বাবার চিঠি’, ‘মেয়ের কাছে বাবার চিঠি’ বা ‘কল্যাণীয়াসু ইন্দু’ নামে অনূদিত হয়েছে। শিশু-কিশোরবান্ধব এই বইটিতে পৃথিবীর ইতিহাস, দর্শন সম্পর্কে সহজ ভাষায় অনেক কিছু বলা হয়েছে যা কি না অনেক কম বয়সেই শিশুদের মনের দরজা-জানালা খুলে দিতে ভূমিকা রাখতে পারে। জওহরলাল নেহরু এর বই সমূহ সাধারণত ইতিহাসকেন্দ্রিক ও তাঁর রাজনীতির অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত। ‘পৃথিবীর ইতিহাস’, ‘দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’, ‘টুওয়ার্ড ফ্রিডম’ বইগুলো তাঁর বেশ বিখ্যাত লেখনীর অন্তর্ভুক্ত। এসব বইয়ের তালিকায় তাঁর আত্মজীবনীও রয়েছে।