বিভ্রান্ত পথিক উপন্যাসটি লেখা হয়েছে প্রথাগত রীতিকে উপেক্ষা করে। উপন্যাসের নায়ক জাবালি। নায়ক প্রধান উপন্যাস এটি। কিশোর জাবালি সিক্সে পড়ার সময় পাহাড়ি বন্ধু থানচি মুরং মার্মার প্ররোচনায় তারই বন্ধুর সাথে শুরু হয়েছিলো প্রথম খুলে দেখা। তারপর আর থামতে হয়নি তাকে। কোন না কোনভাবে কেউ না কেউ এসে গেছে তার জীবনে। এক জীবনে নিজ খালা-ফুপুকেও খুলে দেখতে দ্বিধা করেনি। এমনকি মা-বাবার সঙ্গমকেও উপভোগ করেছে সে। অন্য জীবনে রূপান্তরিত জাবালি। এক মধ্যরাতে স্ত্রী ঝুমু আর পুত্র-কন্যা রকি-শিবাকে ছেড়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ে সে। জীবনের পথে পথে হাঁটতে শুরু করে। পঁয়তাল্লিশ বছরের জাবালি এক জীবনে যা কিছু দেখে এসেছিলো তাই আবার নতুন করে দেখতে এবং ভাবতে শুরু করে। মধ্যরাতে বের হয়ে খোলা মাঠের একপাশে পুকুর অন্যপাশে একটি ভাঙ্গা বাড়ি অন্যমনস্ক জাবালি এখানে শুয়ে থাকে। এমন সময় দেখতে পেলো দেবতাতুল্য অতুলদাকে কাগজী মুদ্রার বিনিময়ে রতি মুদ্রার বিনিময় করতে। ভ্যাবাচেকা খেয়ে যান তিনি। অথচ এলাকায় সবার কাছে তিনি ঈশ্বরতুল্য। সবার বিপদ-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি আপন মমতায়। এরপরের ঘটনায় আরো বেশি খটকায় পড়েন জাবালি। দেখতে পেলেন, বদনা হাতে নিয়ে বের হয়েছেন মাদ্রাসার আল আমিন হুজুরÑ যাঁর মুখে পরকালের হাদিস এবং এর শানেনযুলের খই ফুটে সবসময়। যখন তিনি এসব হাদিস বর্ণনা করেন তখন তাঁর চোখে-মুখে নূরের আলো ফুটে উঠে। সেই তিনি হস্ত মৈথুন করছেন! এ উপন্যাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, হিজরা, অন্ধ, মাজার সংস্কৃতি, ধর্ম, আদি মানুষের চাল-চলনসহ বিশ্ব রাজনীতিও সমানভাবে প্রতীয়মান। নায়ক দেশ-বিদেশে জীবনের পথে-প্রান্তরে হেঁটে যাকিছু দেখেছেন, লেখকের বর্ণনায় তাই উঠে এসেছে অবলীলায়। লেখকের বর্ণনায় ঘটনাবহুল ঘটনাগুলোর প্রতিচ্ছবিই যেন জীবন্ত হয়েছে। এ উপন্যাসে সবার চরিত্রের গুরুত্ব সমান। মুক্তিযুদ্ধে মিনুর ভূমিকা যেমন অসামান্য তেমনি ফুটপাথ থেকে উঠে এসে জবা নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেও উজ্জ্বলতর এক নারী হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে আর দীপা তো এ দেশের শাশ্বত নারীর সহজাত রূপে আবির্ভূত হয়েছে। ঔপন্যাসিক মফিদা আকবরের এতো প্রাণবন্ত উপস্থাপনা ও অসামান্য গল্প বলার ঢং উপন্যাসটিকে ভিন্ন মাত্রায় এগিয়ে নিয়েছে। সাহিত্যরসে ভরপুর গ্রন্থটি একটানে গড়গড় করে না পড়ে উঠার উপায় থাকে না। এ উপন্যাসটি শুধু সামাজিক উপাখ্যানই নয়, বরং এ গ্রন্থে জানার এবং শেখার অনেক উপাদান রয়েছে। বোধ করি এ উপন্যাসটি লিখতে লেখককে অনেক পড়াশোনা করতে হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে এ উপন্যাসটি একটি বিশেষ জায়গায় স্থান পাবে বলে আশা করি। আমি ঔপন্যাসিক মফিদা আকবরের বিভ্রান্ত পথিক উপন্যাসের বহুল প্রচার ও প্রসার কামনা করছি।
সৈয়দা রুখসানা জামান শানু বিশিষ্ট সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, কবি ও কথাশিল্পী